বাক্‌ ১৫৩ ।। আবেশ কুমার দাস


 

তারকা, অভিনেতা ও মহানায়ক: প্রসঙ্গ অন্য উত্তমকুমার

 

হাসতে ভুলে যাওয়ার আক্ষেপ ঝরে পড়েছিল তপন সিংহর ছবির সেই প্রৌঢ় নায়কের কণ্ঠে। যে খেদোক্তির অব্যবহিত পূর্বেই যদিও প্রাণ খুলেই হাসতে দেখা যায় তাকে। তবে সে হাসিকে ঠিক ‘উত্তমকুমারের হাসি’ বলা যাবে নাযার সম্পর্কে নাকি লাগসই হতে পারত স্বপন মল্লিকের উক্তিটা: …smile caused a million hearts to miss a beatআসলে ‘জতুগৃহ’-র (১৯৬৪) উক্ত নদীবক্ষের দৃশ্যে অভিনেতার (ঘটনাচক্রে যাঁর নামটা উত্তমকুমার) কাছে চিত্রনাট্যের দাবি ছিল শতদলের ঢঙে হাসার। উত্তমকুমারের ট্রেডমার্ক ভঙ্গিতে নয়। কিন্তু কোথায় ফারাক শতদলের হাসি ও উত্তমকুমারের হাসির ব্যঞ্জনায়?

খুব সহজ একটা উত্তর হয় প্রশ্নটার। তবে আগে ঈষৎ প্রসঙ্গান্তরে গেলে ক্ষতি নেই‘আমার সময়’ জুলাই, ২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘মধ্যবিত্তের ছায়ারোদ্দুর’ শীর্ষক আলোচনায় ‘জতুগৃহ’ প্রসঙ্গে এক মহার্ঘ অবলোকন মেলে প্রাজ্ঞ চলচ্চিত্র সমালোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের কলমে: ‘...যখন আমাদের ষাটের দশকের ইতিহাস অশান্ত ও অনিশ্চিত তখন তপন সিংহ ভাবতে পারছেন অভ্যন্তরীণ ভাঙনের কথা ‘জতুগৃহ’ (১৯৬৪) ছবিতে; এখানে সময় ছায়া ফেলছে না সরাসরি’। এমন ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে রূপদান বাজারচলতি ছবির (সচেতন ভাবেই এখানে ব্যবহৃত হয়নি ‘কমার্শিয়াল’ শব্দটি; যেহেতু আর্ট ও কমার্শিয়াল ছবির প্রভেদের প্রবণতা প্রচলিত হয়নি তখনও) বাঁধা গতে সম্ভব ছিল না ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র (১৯৫৪) কিরীটী, ‘সাগরিকা’-র (১৯৫৬) অরুণ বা ‘পথে হল দেরী’-র (১৯৫৭) জয়ন্তদের পর্দায় উত্তম হয়ে উঠতে বাধা তো নেই-ই, উপরন্তু সেটাই কাঙ্ক্ষিত (ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রদের নামও তাই চট করে বলতে পারেন না দর্শক) কিন্তু ‘জতুগৃহ’-র দাবি ছিল উত্তমের শতদলে রূপান্তর। বরং চিত্রনাট্যমাফিক ‘নায়ক’-এর (১৯৬৬) অরিন্দমেরও কিছু কিছু দৃশ্যে উত্তম হয়ে ওঠার বৈধতাই হয়তো ছিলশতদলের বেলায় ছিল না সেটুকুও ছাড় তার হাসিতে ভক্তকূলের উন্মত্ত সিটি পড়ার কথাই ছিল না প্রেক্ষাগৃহে। কিন্তু যেভাবে ধ্রুপদী সাহিত্যের কাছে ফিরে যায় তাপিত মানুষ, সেভাবেই অন্তর্দাহের কিঞ্চিৎ উপশম প্রচ্ছন্ন থাকতে হত উক্ত হাসিতে। তারকা উত্তম ও অভিনেতা উত্তমকুমারের হাসিতে এখানেই ফারাক।

ইংরেজি ‘আফটারলাইফ’ শব্দটিকে এক অনবদ্য ব্যঞ্জনায় উত্তমের জনপ্রিয়তার ব্যাখ্যায় হালফিলে ব্যবহার করতে দেখা যায় গবেষক সায়নদেব চৌধুরীকে। প্রয়াণের চার দশকের ব্যবধানেও বাঙালির মনোজীবনে তাঁর প্রভাবের গভীরতা বোঝাতে উত্তমের মতো যে আর কেউ হবে না সে কথাটা তো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে গিয়েছেন বিশপ লেফ্রয় রোডের সেই দিগ্‌বিজয়ী মানুষটাই মজা হল, সত্যজিৎ রায়ের উক্ত মতবাদে বিশ্বাসীদের ভিড়ে আজ দেখা মিলবে দু’ জাতের বাঙালিরতারকায় মন্ত্রমুগ্ধদের মুখে যেমন শোনাই যাবে না ‘উপহার’ (১৯৫৫), ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ (১৯৬০) বা ‘যদুবংশ’-র (১৯৭৪) নাম, অভিনেতার অনুরাগীরা পত্রপাঠ নাকচ করে দেবেন ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সাগরিকা’ বা ‘পথে হল দেরী’-দের। এখান থেকেই হয়তো সূত্রপাত একটা সংকটের মাত্র চুয়ান্নতেই অকালপ্রয়াত মানুষটি মৃত্যুর তেতাল্লিশ বছর পর আজও উক্ত দু’ দলের কাছ থেকেই একাধারে অর্জন করে চলেছেন বটে মুগ্ধতা তথা অবিমিশ্র শ্রদ্ধা কিন্তু সেই মাপে বৌদ্ধিক মূল্যায়নের (ব্যক্তিগত জীবন, সুচিত্রা-উত্তম চর্চা বা নিষ্ঠার ফিরিস্তির কথা হচ্ছে না অবশ্যই) জায়গাটায় রয়ে গিয়েছে অনেকাংশেই ফাঁকিযেহেতু তারকার ভক্তকূলের কর্ম এ নয়। আর সেই ‘উপহার’-এর যুগ থেকেই তারকার পাশে জনৈক সমান্তরাল উত্তমের উপস্থিতি সত্ত্বেও প্রথমের দীর্ঘ চলচ্চিত্রপঞ্জির (তথা ম্যাগনাম ইমেজ) চাপে প্রাপ্য মনোযোগ থেকে বঞ্চিতই হয়ে এসেছে মহত্তর শিল্পকর্মগুলিনাড়াচাড়া যতটুকু হয়েছে তার বৃহদংশই আবার ‘নায়ক’-চর্চা (সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় অবধি মনে করেছেন উত্তম আজীবনে ওই একটি উল্লেখযোগ্য কাজই করেছিলেন) কিছুটা ‘জতুগৃহ’। অগ্রদূতের নির্দেশনায় অনেক আগেই নির্মিত ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-কে ঘিরেই বা তত উচ্চবাচ্য হয় কই?

'জতুগৃহ'


তারকার খোলস সরিয়ে চরিত্রের বাস্তবতামাফিক হাসতে পারার যে অনুষঙ্গ থেকে সূত্রপাত বর্তমান নিবন্ধের, সেই সূত্রেও এ ছবি সম্পর্কে বলাই যাবে দু’-চার কথা। নিজেকে অতখানি ডিগ্ল্যামারাইজ শতদল হয়ে উঠতেও করতে হয়নি উত্তমকুমারকে, যতটা অনিবার্য ছিল রাইচরণের খাতিরেনিকট দৃষ্টান্ত হতে পারে পার্থপ্রতীম চৌধুরীর নির্দেশনায় ‘যদুবংশ’-র গণাদা। যদিও সে অনেকটাই পরবর্তীকালের কথা। যখন নিজ শিল্পীসত্তাকে ঘিরে দৃশ্যতই সচেতন হয়ে উঠেছেন মহানায়ক যাক, রাইচরণকে বুঝতে ‘পুরাতন ভৃত্য’-র স্রষ্টার কলমের দু’-তিনটি আঁচড়ই যথেষ্ট,

এই নবজাত শিশুটির প্রতি রাইচরণের অত্যন্ত বিদ্বেষ জন্মিল। মনে করিল, এ যেন ছল করিয়া খোকাবাবুর স্থান অধিকার করিতে আসিয়াছে। মনে করিল, প্রভুর একমাত্র ছেলেটি জলে ভাসাইয়া নিজে পুত্রসুখ উপভোগ করা যেন একটি মহাপাতক। রাইচরণের বিধবা ভগ্নী যদি না থাকিত তবে এ শিশুটি পৃথিবীর বায়ু বেশিদিন ভোগ করিতে পাইত না।

আখ্যানের রাইচরণের এই ভৃত্যভাব পর্দার রাইচরণে সংক্রামিত হয় স্রেফ একগাল মেঠো হাসিতেইশহুরে ভদ্রলোকের কর্মই নয় অমন হাসিনিজের জন্য পাঁচ সিকা মূল্যের ফতুয়া খরিদের পয়সার কিছুটা বেখেয়ালে খোকাবাবুর (চরিত্রায়ণে মাস্টার বাবু) খেলনায় খরচ করে ফেলার দৃশ্যটি নয় চিত্রনাট্যকারের নির্মাণকিন্তু তিন পুরুষের ভৃত্য রাইচরণকে পর্দায় অমন গেঁয়ো বেখেয়ালি চেহারায় বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার কৃতিত্বটুকু নিঃসন্দেহে অভিনেতার ঝুলিতেই জমা পড়বে সঙ্গে সঙ্গেই দর্শকের চোখে বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়ে যাবে চতুর্থ পুরুষে পৌঁছে মায় আপন বংশধারাকেও বাবুদের হাতে তুলে দেওয়ার অমন চমকপ্রদ পরিণতিটুকু

কথাসাহিত্যিকের মায়াবী কলম হরেক অবিশ্বাস্যতাকেই অবলীলায় এনে ফেলে পাঠকের বিশ্বাসযোগ্যতার আওতায়কিন্তু দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতায় তাদের প্রতিষ্ঠা অত হেলার কর্মটি নয়। সাহিত্যকাহিনির দৃশ্য দৃশ্যান্তর থেকে রুপোলি পর্দায় সত্যজিৎ রায়ের বারংবার বিচ্যুতির (এমনকি কথাকারের নামটা সত্যজিৎ রায় হলেও) নেপথ্য হেতুই যা নতুন ভাবনার খোঁজ দেওয়া যদি কথাকারের দায়িত্ব হয়, অভিনেতার কর্তব্য সেই চিন্ময়কে মৃন্ময় করে তোলা। মধ্যবর্তী সেতুবন্ধের দায়টা যথাক্রমে চিত্রনাট্যকার তথা নির্দেশকের। আলোচ্য রবীন্দ্র-কাহিনির পরিণতিকেই যত অক্লেশে গ্রহণ করে পাঠক, চিত্রনাট্যে সেই অনুপাতে রয়ে যাওয়া অন্তত একটি খামতিকে বেশ চোখে পড়েই যায় সচেতন দর্শকেরযে চনমনে রাইচরণ খোকাবাবুর জীবনকালেই ঘোরতর অমনোযোগী ছিল আপন দাম্পত্যে, মনিবপুত্রটির অপমৃত্যুতে উন্মাদপ্রায় হয়ে ওঠা সেই মানুষটাই কেমন করে তত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল ঘরণীর (চরিত্রায়ণে সুমিতা সান্যাল) যাতে শেষাবধি ঘটল সন্তানলাভ, ছবি থেকে মেলে না সেই সংশয়ের কোনও সদুত্তরই অবশ্যই রবীন্দ্রনাথও খোলসা করে যাননি সেসব কিন্তু ছোটগল্পের দৃঢ়পিনদ্ধ বুননে সেসব খটকাও জাগে না পাঠকমনে। বরং তার অযাচিত উত্থাপনাই আরোপিত ঠেকত পাঠানুভূতিতেকিন্তু সচেতন দর্শকের চিত্তে জাগেই সন্দেহটা এ খামতির দায় যদিও অভিনেতার নয়। বরং বাড়তি কিছু ফাঁক যদি থেকেও থাকে চিত্রনাট্যে, তাকে সযতনেই বুজিয়ে দিয়েছে উত্তমকুমারের অভিনয়। একটা কথা যার দরুণ বলাই যাবে উত্তমের নামোচ্চারণে অবশ্যই রাইচরণকে অগ্রেই মনে পড়বে না বাঙালিরকিন্তু রাইচরণ বলতে মনে পড়ে যাবে উত্তমকুমারকেই। সৎ শিল্পের মজাটা এখানেই।

শতদলের পরিশীলিত হাসি মেঠো রাইচরণের ঠোঁটের কোনায় বেমানানবৃদ্ধ অঘোরের (চরিত্রায়ণে যোগেশ চট্টোপাধ্যায়) প্রতি ম্যাটিনি আইডল অরিন্দমের হাস্যে ফুটে থাকে শ্লেষ এবং এরা কেউই স্বপন মল্লিক বর্ণিত সেই রমণীমোহন হাসিটা নয়। বরং স্ট্রাগলিং অরিন্দমের অভিব্যক্তিতে বেশ চেনা যায় তারকা উত্তমকেবিজয়া দশমীর রাতে শ্মশানে পুড়তে থাকা শঙ্করদার (চরিত্রায়ণে সোমেন বোস) শবের পাশে অপেক্ষারত অরিন্দমের হাসিতে দিব্য দেখা মেলে যাঁর লোকপ্রিয় অভিনয়রীতিরপ্রতিষ্ঠিত অরিন্দমের হাবভাবে ইতালীয় অভিনেতা মার্সেলো মাস্ত্রোনির ছায়া দৃষ্টিগোচর হলেও (সমসাময়িক বিশ্ব চলচ্চিত্রের গতিপ্রকৃতি বিষয়ে সম্যক ওয়াকিবহাল সত্যজিতের সূত্রেই হয়তো ঘটেছিল যা) অভিনয়ের উক্ত ভঙ্গিমাকে সম্ভবত নিজের মাপে আত্মস্থই করে নিয়েছিলেন উত্তমকুমার। প্রসঙ্গত, ‘নায়ক’-এর স্বপ্নদৃশ্যের সঙ্গেও দূর সম্পর্কীত আত্মীয়তা খেয়াল করাই যাবে মাস্ত্রোনি রূপায়িত ফেলিনির ছবির নায়ক গুইডোর অন্তর্দ্বন্দ্বের তবে শতদল, রাইচরণ, গণাদা বা অরিন্দমের দেহধারী অভিনেতা উত্তমকুমার কিন্তু আপন শিক্ষাগুরু মানতেন বাংলা মঞ্চ ও রুপোলি পর্দার বরিষ্ঠ নট সন্তোষ সিংহকে। সাংবাদিক রবি বসুর স্মৃতিচারণে জানা যায় ছাপ্পান্ন জাতের ফেশিয়াল এক্সপ্রেশন অধীত ছিল মানুষটির। যার একটা অন্তত বাঙালির স্মৃতিতে অক্ষয় হয়েই আছে ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’-এর (১৯৭৯) সেই গলির দৃশ্যে।

যদিও উত্তমের বেলায় তারকার ম্যাগনাম ইমেজের বলয়গ্রাসে অভিনেতার আড়াল হয়ে পড়ার পশ্চাতে স্বয়ং ব্যক্তি মানুষটির কিছু প্রচ্ছন্ন মদতও অবশ্যই ক্রিয়াশীল হয়েছিল। যার একটা দৃষ্টান্ত মেলে হরিদাস ভট্টাচার্য নির্দেশিত ‘শেষ অঙ্ক’-র (১৯৬৩) নেপথ্য ইতিহাস ঘাঁটলেইকল্পনাকে (চরিত্রায়ণে শেফালী বন্দ্যোপাধ্যায়) কণ্ঠরোধ করে হত্যার দৃশ্যে নিজের নায়কের ভাবমূর্তি ধূলিসাৎ হওয়ার আশঙ্কায় ছবিটি থেকেই পিছিয়ে যেতে চেয়েছিলেন উত্তম। শেষে সমাধান মেলে কানন দেবীর বুদ্ধিতে অনিচ্ছাকৃত হত্যার রং লাগানো হয় চিত্রনাট্যে। অবশ্যই নেতিবাচক রোলে উত্তমের রূপদানের অগ্রগণ্য দৃষ্টান্তই হয়ে থাকবে ‘শেষ অঙ্ক’-র সুধাংশু। তবু পিছনের গল্পটা জানলে হোঁচট লাগে বই-কি। নিজের জেদে যিনি পরবর্তীকালে রূপায়িত করবেন ‘বাঘবন্দী খেলা’-র (১৯৭৫) দোর্দণ্ডপ্রতাপ ভবেশ বাঁডুজ্জেকে, যে প্রবল মেথড অ্যাক্টিং-এ স্রেফ মন্ত্রমুগ্ধ হবে বাঙালি, ভাবমূর্তির প্রশ্নে সেই মানুষটিরই এমন সতর্ক মধ্যবিত্তয়ানার কী ব্যাখ্যা?

ভবেশ বাঁড়ুজ্জের বেশে


বোধহয় ব্যাখ্যাটা প্রচ্ছন্ন থাকে ব্যক্তি অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অতীত প্রেক্ষাপটেসায়নদেব চৌধুরীর মতে উত্তমের অলৌকিক জনপ্রিয়তার পশ্চাতে অনেকটাই ক্রিয়াশীল হয়েছিল তাঁর নিপাট মধ্যবিত্তের পটভূমিজনতার জনৈকের উত্থান তথা তাঁর মধ্য দিয়েই আপন অধরা স্বপ্নপূরণের তাড়নাই উত্তমে মজিয়েছিল স্বাধীনতা-উত্তর অধ্যায়ের বাঙালিকেফিরে তাকানো যাক সেই কালখণ্ডের সামাজিক বাস্তবতায়দেশভাগের মূল্যে এসেছিল বাঙালির স্বাধীনতা। পরিণামে একদিকে যদি সাত পুরুষের ভিটেমাটি খুইয়ে একদঙ্গল মানুষকে আশ্রয় নিতে হয় শিয়ালদহ স্টেশনে, আর-একদলকেও সইতে হয়েছিল আপন অর্থনীতিতে আচমকাই এসে লাগা উদ্বাস্তু সমস্যার ভরবেগসাংস্কৃতিক আভিজাত্য তথা বংশকৌলীন্যে উজ্জ্বল দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ছবি বিশ্বাস বা প্রমথেশ বড়ুয়াদের প্রহর ছিল না সময়টা। বদলে ম্যাট্রিকুলেশনের পালা চুকিয়েই (গভর্নমেন্ট কমার্স কলেজে ভরতি হলেও অবিলম্বেই যতি পড়ে ইন্টারমিডিয়েটের পাঠে) পরিবারের হাল ধরতে হওয়া জনৈক তরুণের মধ্যেই আত্মপ্রতিকৃতির খোঁজ পেয়েছিল বাঙালি। সেপ্টেম্বর ৩, ১৯২৬-এ ভূমিষ্ঠ অরুণের পিতা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় বৃত্তিতে ছিলেন মেট্রো সিনেমার সামান্য প্রোজেকশনিস্ট। ব্রাহ্মণ্য পদবিটুকু ব্যতিরেকে ছিল না বংশকৌলীন্যের ছিটেফোঁটাওএমন প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় ওরফে উত্তমকুমারের তারকা ভাবমূর্তির আগাপাশতলাই মধ্যবিত্তের যাবতীয় চরিত্রলক্ষণকে সঙ্গী করেই নির্মিত হয়ে উঠেছিলউপরন্তু পাঁচের দশকে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করা যে ছবিগুলির (শিল্পমূল্য যাই হোক না কেন) সূত্রে বাঙালির লোককথায় ঠাঁই হওয়া সুচিত্রা-উত্তম জুটির, সেখানেও ছবি বিশ্বাস বা কমল মিত্রদের অবয়বে পরিস্ফুট ফিউডাল প্যাট্রিয়ার্কদের বিপ্রতীপেই উত্থান কেন্দ্রীয় চরিত্রদের ‘স্ত্রী’-র (১৯৭২) মাধব দত্তকে রূপায়ণের তাগিদে স্বয়ং উত্তমকুমারের ছবি বিশ্বাসের অভিনয়রীতির অনুগমন অনেক পরের ঘটনা। সমকালীন সত্যটা ছিল, মরিস কলেজের স্নাতক বসন্ত চৌধুরীর শাণিত উপস্থিতিকে অতিক্রম করে উত্তমের মহানায়ক হয়ে ওঠা। পরবর্তী অধ্যায়ের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও তাই যদি অর্জন করে থাকেন বুদ্ধিজীবীমহলের মুগ্ধতা, উত্তমকুমারের অনুরাগী ছিল আপামর জনতায় মিশে। শিল্পী যে শ্রেণি বাস্তবতারই সন্তান— উত্তমের তারকা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটুকুতে মেলে তারই স্বীকৃতি

যা যা বলা হল বিগত অনুচ্ছেদে, স্রেফ ‘শেষ অঙ্ক’-ই মেলে না তাতে। বরং তারকা উত্তম ও হিন্দি রুপোলি পর্দার বন্ধুর রসায়নেরও একটা দূর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতেই পারে উক্ত ব্যাখ্যায়। যেহেতু একটি ছবির বাণিজ্যিক বিফলতাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি ‘ছোটিসি মুলাকাত’ (১৯৬৭) পর্বনিজ প্রযোজনার বিপুল আর্থিক ক্ষতি শুধতে এরপর বম্বেতে পরপর অপাঙ্‌ক্তেয় কাজ করে চলতে হয় উত্তমকেযা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে আরব সাগর পাড়ে তাঁর ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পক্ষেই যথেষ্ট ছিল। গোটা ঘটনাপ্রবাহকে ঘিরে ষড়যন্ত্র-সন্ধানী বাংলায় স্বভাবতই পল্লবিত হয় হরেক গালগল্প। সেসব বাদ দিয়ে ভাবতে বসলে শুরুতেই যা মনে হয় আজ— প্রযোজক হিসেবে কাহিনি নির্বাচনেই প্রথম ভুলটা হয় উত্তমেরসত্তরোর্ধ্ব বাঙালি হয়তো আজও বুঁদ হয়ে থাকতে পারে ‘অগ্নিপরীক্ষা’-য়, কিন্তু বিদ্যাসাগরের বাংলার ভূমিপুত্র উত্তমের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ সম্ভবত চিন্তা করে দেখেনি সেদিন যে বাল্যবিবাহের গল্পকে আদৌ কতটা গ্রহণ করবে বম্বেবিগত দশকেই যেখানে নির্মিত হয়ে যায় ‘এক হি রাস্তা’-র (১৯৫৬) মতো ছবি, যার আখ্যানে খুল্লমখুল্লা সমর্থনই মেলে বিধবা বিবাহের অনুকূলে

খানিক প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে এখান থেকে চোখ ফেরানো যাক ‘নায়ক’-এর সেটের সেই বহুশ্রুত ঘটনাটুকুতে। অদিতিকে (চরিত্রায়ণে শর্মিলা ঠাকুর) অটোগ্রাফ দেওয়ার যে দৃশ্যটি তুলতে গিয়ে দেখা যায় সকাল থেকে বুকপকেটে পড়ে থাকতে থাকতে শুকিয়ে গিয়েছে উত্তমের কলমটির কালি। যে ঝঞ্ঝাট আকছারই হত ঝরনা কলমে (একালেও যাঁরা ব্যবহার করেন, জানা থাকবে)বিপত্তি বুঝে সত্যজিৎ রায় ক্যামেরা থামানোর নির্দেশ দিতে গেলেও সামনে রাখা গ্লাসের জলে নিব চুবিয়ে নিমেষেই সমস্যা উতরে দেন মহানায়কনিরুপদ্রবেই চলতে থাকে শুটিং। বরং ঘটনাটি চিত্রনাট্যেরই অন্তর্গত এক দৃশ্যের রূপ পেয়ে যায় পর্দায়। প্রসঙ্গত, রুপোলি পর্দায় অভিনয়ের বিধি বিষয়ে ছবি বিশ্বাসের অভিমতকে উদ্ধৃত করা যাবে এই স্থলে,

চলচ্চিত্রাভিনয়ের মূলমন্ত্র দুটি: কনসেনট্রেশন অফ্‌ মাইণ্ড অথবা মনঃসংযোগের একাগ্রতা এবং রেসট্রেন্ট অথবা সংযম। চলচ্চিত্রের জন্যে শিল্পী যখন অভিনয় করবেন, অভিনয়ের চরিত্রের সঙ্গে তাঁর তখন মোটামুটি একীভূত হওয়া আবশ্যক। তার জন্যে একাগ্রচিত্ত হতে হবে... কিন্তু চরিত্রের সঙ্গে একীভূত হতে গিয়ে শিল্পী যেন সম্পূর্ণভাবে আত্মবিস্মৃত না হন। তাই মনঃসংযোগের একাগ্রতার সঙ্গে সঙ্গে সংযমের কথা বলছি। অভিনেতার সত্তা যেন তখন দুভাগে বিভক্ত। প্রধান অংশটি যেন অভিনেয় চরিত্রের দুঃখ, সুখ ভাবানুভূতির সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিয়েছে; আর অপর অংশটি সেন্সর বা বিচারক— যে প্রথমের প্রতি পদক্ষেপের মাত্রা যেন নিয়ন্ত্রণ করে দিচ্ছে।

‘নায়ক’-এর সেটের উক্ত ঘটনাটি ও মহানায়কের উপস্থিত বুদ্ধির সঙ্গে কাঁটায় কাঁটায় মিলে যায় এই উপদেশজানা যায়, খুশিতে তারিফ করে উঠেছিলেন স্বভাবগম্ভীর সত্যজিৎ রায় অবধি তার আগে পর্যন্ত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেই যাঁর প্রিয় অভিনেতা হিসেবে জানত বাঙালি। প্রসঙ্গত, নিজের তরফে কিছু খামতিকে স্বীকার করে নিয়েও (বিশদে আর কিছু না ভাঙলেও ‘অন্তরীপ’ বৈশাখ, ১৪২৮ সংখ্যায় এ বিষয়ে অনুসন্ধানে তৎপর হয়েছেন সৌরভ মুখোপাধ্যায়; আগ্রহী পাঠক চোখ রাখতে পারেন যাঁর বিশ্লেষণে) ‘নায়ক’-এর উত্তমকুমারকে একেবারে খুঁতহীন বলে রায় দিয়েছিলেন সত্যজিৎ।

ঘটনাটি আলাদা করে উল্লেখের তাৎপর্য অবশ্যই থেকে যায়যে বিচক্ষণতা ব্যক্তি উত্তমের ছিল না একেবারেই, শিল্পী উত্তমকুমারের যে তা ষোলোআনাই ছিল তা-ই প্রমাণিত হয় এ ঘটনায় আসলে তারকা উত্তম ও অভিনেতা উত্তমকুমারের আদলেই ব্যক্তি উত্তম ও শিল্পী উত্তমকুমারও যেন দুই সমান্তরাল সত্তা। একজন ভুল প্রযোজনায় (তাও বিদেশ বিভুঁইতে) বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে দাঁড় করান নিজেকে অন্যজন নির্দেশককেও অতিক্রম করে (তাও সত্যজিৎ রায়ের মাপের) ছবির দৃশ্যে সংযোজিত করেন বাড়তি শৈল্পিক মাত্রা। ঘটনা হল, সেই সূত্রেই আবার তারকা উত্তমের মজ্জাগত মধ্যবিত্তয়ানা ও ব্যক্তি উত্তমের প্রভূত অবিবেচনাকে হিসেবে রেখেই শিল্পী উত্তমকুমারের বিপুল অর্জনের নেপথ্যে চিনে নেওয়াই যাবে অভিনেতা উত্তমকুমারের গভীর মাহাত্ম্যকে।

এখানে উল্লিখিত থাক সেই ছোট্ট তথ্যটিহিন্দি ছবিতে মুখ দেখাতে হয়তো ছয়ের দশক অবধি অপেক্ষাই করতে হত না উত্তমকে। যদি মুক্তি পেত ভোলা আঢ্যর নির্দেশনায় ১৯৪৮-এ টালিগঞ্জেই তোলা ‘মায়াডোর’। তথ্যটির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে বাঙালির ধনাঢ্য অতীতের এক উজ্জ্বল অধ্যায় পাহাড়ী সান্যাল বা কানন দেবীর চলচ্চিত্রপঞ্জির আদিপর্বে চোখ রাখলে বহু হিন্দি ছবির নামই নজরে আসে যথা, ‘দেবদাস’ (১৯৩৫), ‘বিদ্যাপতি’ (১৯৩৭) বা ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’ (১৯৩৮)। যাদের নির্দেশকরা ছিলেন যথাক্রমে প্রমথেশ বড়ুয়া, দেবকী বসু বা ফণি মজুমদারের মতো মানুষজনআসলে খোদ কলকাতা শহরেই তোলা ছবিগুলিঅধুনা রূপকথার মতো শোনালেও সেই তিন ও চারের দশকে সংস্কৃতির পাশাপাশি ভারতীয় সিনেমার অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্রটিরও অবস্থিতি ছিল কলকাতায়। এখান থেকেই তোলা হত হিন্দি বা উর্দু ছবি। অ্যান্ডারসন থিয়েট্রিক্যাল কোম্পানি বন্ধ হয়ে যেতে রুজির প্রয়োজনে খোদ পৃথ্বীরাজ কাপুর সপরিবারে রয়ে যান এই শহরেকালীঘাট এলাকায় নেন বাসা ভাড়াকাজ করেন নিউ থিয়েটার্সের কিছু ছবিতে। বীরেন্দ্রনাথ সরকার প্রতিষ্ঠিত যে সংস্থাটির মূলমন্ত্র ছিল: ‘জীবতাং জ্যোতিরেতু ছায়াম্‌’ ব্যবসা চলত গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে। যে ইতিহাসের কিছু কিছু আঁচ মেলে তপন সিংহর শেষ জীবনের লেখা ও সাক্ষাৎকারে। টলিপাড়ার সুদিন ফেরানোর প্রশ্নে নয়ের দশকেও যিনি বলে গিয়েছেন কলকাতা থেকে ফের হিন্দি ছবি তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা যদিও বর্তমান নিবন্ধের আওতাধীন নয়। প্রসঙ্গটার উত্থাপনা ঘটেছে ভিন্ন কারণে।

ঘটনা হল, ঠিক যখন শুরু হতে চলেছে পেশাদার অভিনেতা হিসেবে উত্তমের কর্মজীবন, বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসের উজ্জ্বল দিনগুলি তখন সদ্য অতীত। এবং প্রায় সমান্তরালেই ঘটছিল দু’টি ঘটনা। একদিকে দেশভাগের ধাক্কায় যদি ক্রম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বাংলার অর্থনীতি, পক্ষান্তরে নতুন নতুন স্টুডিও গড়ে উঠছিল বম্বেতেভারতীয় সিনেমার অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্রটির স্থানান্তরণের সঙ্গে সঙ্গেই বিমল রায়ের মতো মানুষেরা পাড়ি জমাতে লেগেছিলেন আরব সাগর পাড়ের শহরটিতেকলকাতা পোর্ট কমিশনারের চাকরিতে ফাঁকি দিয়ে সিনেমাপাড়ায় ঘোরাঘুরি করা অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের প্রথম ছবির (যা কিনা হতেই পারত প্রথম হিন্দি ছবিও) ক্যান থেকেই না বেরোতে পারাকে কি এই প্রেক্ষাপটের নিরিখেই বলা যায় প্রতীকী? হয়তো। দেবী মুখোপাধ্যায়ের মতো অধুনাবিস্মৃত অভিনেতার (আদি সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের স্বামী হিসেবে মনে রাখতে পারেন অশীতিপর মানুষদের কেউ কেউ) ঢঙে কলকাতায় বসেই অবশিষ্ট ভারতবর্ষের মনোযোগ আকর্ষণের সেই সাবেক সুযোগটাই আর রইল না লক্ষণীয়, অভি ভট্টাচার্য বা প্রদীপকুমারের মতো অভিনেতারাও তখন ভাগ্যের খোঁজে উড়ে যাচ্ছিলেন বম্বে।

এখানে একটা বিশুদ্ধতার প্রশ্ন তুলতে পারেন কেউ কেউ। উত্তমের বম্বে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে ঘিরে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ঢঙে জাতীয় মনোযোগ আকর্ষণের বদলে আন্তর্জাতিক পরিচিতি গড়ে তোলার দিকে মনোযোগী হওয়ার বিপ্রতীপ দৃষ্টান্তটির উত্থাপনাও ঘটতেই পারে প্রসঙ্গতযদিও আত্মবিশ্বাসহীনতাকে আড়াল করার একটা সহজ পন্থা প্রায়শই জোগায় আদর্শের ভেক। বাঙালির অধুনা অধোগতির পশ্চাতে যার ভূমিকা নেহাত কমও নয়। এটুকু বলাই যায়, ভুল প্রযোজনার প্রশ্নে হয়তো আঙুল তোলাই যাবে উত্তমের দিকে উপরন্তু লম্বা দৌড়ে টিকে থাকার জন্য পরপর উপযোগী চরিত্র পাওয়ার পক্ষে কথ্যহিন্দিটাও খুব দরের ছিল না তাঁর। তবে আসানসোল ফুরোলেই নিজের গতিবিধির উপর অদৃশ্য দ্রাঘিমা টেনে আঞ্চলিক মনসবদার সেজে বসে থাকার অন্তঃসারশূন্যতার ঊর্ধ্বে ওঠার চেষ্টাটুকু অন্তত ছিল উত্তমকুমারেরউপরন্তু, সত্যজিৎ রায়ের উপর্যুপরি ছবির সূত্রে অনতিবিলম্বেই আন্তর্জাতিক পরিচিতি অর্জনের যে সুযোগটা ঘটেছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বরাতে, উত্তমকুমারের ঠিকুজিতে লেখা ছিল না তেমন কিছুই আর-একটা কথাও বোধহয় বলাই যাবে এখানেহলিউডে পায়ের তলায় জমি নির্মাণের প্রচেষ্টার পরিণাম কিন্তু সুখকর হয়নি খোদ বিশপ লেফ্রয় রোডের বিখ্যাত বাসিন্দার বেলাতেও। প্রযোজকদের দোরে দোরে ঘুরতে ঘুরতেই কীভাবে যেন ফাঁস হয়ে যায় চিত্রনাট্যের খসড়া।

ঘটনা হল, উত্তমকুমারের কথায় অমোঘ ভাবেই এসে পড়ে যাঁর নামটি, সেই সুচিত্রা সেনের বম্বে অধ্যায়ের অভিজ্ঞতাকে কিন্তু মোটের উপর সন্তোষজনকই বলা যাবেশক্তি সামন্তর ‘অমানুষ’-এ (১৯৭৫) উত্তমের অভিনয় যদি কিছু মানুষকে টেনে থাকে প্রেক্ষাগৃহে, গুলজারের ‘আঁধি’-র (১৯৭৪) সূত্রে প্রাতঃস্মরণীয়াই হয়ে আছেন সুচিত্রাবস্তুত কথ্যহিন্দি যে খুব উচ্চমানের ছিল তাঁরও, মোটেই বলা যাবে না তেমন কথা। তবু বিমল রায়ের নির্দেশনায় ‘দেবদাস’ (১৯৫৫) থেকে বম্বেতে যে ক’টি ছবিতে কাজ করেছিলেন মহানায়িকা, মোটামুটি ইতিবাচকই হয়েছিল প্রতিক্রিয়া আসলে নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝে পদক্ষেপগ্রহণের বিবেচনাবোধই স্বল্প উপস্থিতিতেও বম্বেতে বাজিমাত করে আসতে সহায়তা করেছিল সুচিত্রাকে। যাক, বম্বে অধ্যায়ে গ্রহণযোগ্যতার এই হেরফের তথা বাংলা ছবির টাইটেল কার্ডেও আগে নাম থাকার যৌথ সংঘটনার তুল্যমূল্য বিচারে কি সুচিত্রা সেনকে খানিক এগিয়েই রাখা উচিত উত্তমকুমারের চাইতে?

এককথায় হয় না এ প্রশ্নের জবাব। দু’জনার সিনেমা-পূর্ব জীবনের সামাজিক অবস্থানের তারতম্য থেকে মেলে ব্যাখ্যাটা। তার আগে চোখ রাখা যাবে আর-একটি ঘটনায়

সন ১৯৭১। চুক্তিপত্রের শর্ত (এক বছর আর কোনও ছবিতে কাজ না করার) পছন্দ না হতে খোদ সত্যজিৎ রায়কেও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সুচিত্রা। ‘দেবী চৌধুরাণী’-কে রুপোলি পর্দায় তোলার পরিকল্পনা ছিল বিশ্ববন্দিত বাঙালি নির্দেশকের। আর হয়নি যে ছবি। উত্তমকুমারের সঙ্গেও অম্লমধুর সম্পর্কই ছিল বিশপ লেফ্রয় রোডের বাসিন্দা দিগ্‌বিজয়ী মানুষটিরজানা যায় সুপ্রিয়া দেবীর এক সাক্ষাৎকার থেকে। তবু রুপোলি পর্দায় এসেছিল ‘নায়ক’। পিছু পিছুই ‘চিড়িয়াখানা’-ও (১৯৬৭)। সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ থেকে যথেষ্টই আভাস মেলে উত্তমকে তার আগে জনৈক ফিল্মি তারকার বাড়তি কিছুই ভাবেননি সত্যজিৎ। একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বদল হয় যে মনোভাবের। গ্রেগরি পেকের চাইতেও বড় অভিনেতার দরাজ স্বীকৃতি দিয়ে যান মহানায়ককে। শিল্পী হিসেবে চ্যালেঞ্জটা আসলে গ্রহণ করেছিলেন উত্তমকুমার।

সুচিত্রা-উত্তম। জুটি হিসেবে লোকমুখে সম্বোধিত হলেও আসলে ভিন্ন মেরুর মানুষই ছিলেন যাঁরা যে ফারাকের অনেকটাই নির্মাণ করে দিয়েছিল দু’জনার ভিন্নতর অতীত অন্তরঙ্গউত্তমের প্রেক্ষাপট বিষয়ে ইতিপূর্বেই অবহিত হয়েছি আমরা। পাবনার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ভূমিষ্ঠ হতে হলেও বৈবাহিক সূত্রে অচিরেই সুচিত্রা অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন আভিজাত্যের অহমিকায়যার ইন্ধনে ততদূর যাওয়া সম্ভব ছিল তাঁর পক্ষে, যতদূর হাঁটা কঠিন হত উত্তমের টাইটেল কার্ডে নামের অবস্থান নিয়ে মনোভাব তথা সত্যজিৎ রায়ের প্রতি দু’জনার দু’ জাতের প্রতিক্রিয়ায় মেলে সেই বাস্তবতারই ইঙ্গিতউপরন্তু সূচনার দিনগুলিতে সিনেমাপাড়ার হাজারো প্রত্যাখ্যানেও যেভাবে লক্ষ্যে অবিচল থাকেন উত্তমকুমার, তাতেই আঁচ মেলে অভিনয়কলার প্রতি তাঁর আন্তরিক অনুরাগের। সুচিত্রার সিনেমায় নামা যেখানে নিজের ইচ্ছায় নয়। পেশাদারের দৃষ্টিতেই দেখার কথা ছিল তাঁর রুপোলি জগৎকে। অভিনয়কলার প্রতি দু’জনার দৃষ্টিভঙ্গির এই তারতম্যকে আরও গভীরে বোঝা যায় মঞ্চাভিনেতা উত্তমকুমারের অবদানকে মাথায় রাখলেই। রুপোলি পর্দায় প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাওয়ার পরও স্টারের ‘শ্যামলী’ নাটকে অভিনয়েই শেষ নয় যার। মনে রাখা দরকার, সিনেমায় নিজের করা রোলটি মঞ্চের ভিন্ন পরিবেশে উপস্থাপনে উঠতি বিশ্বজিৎকে মানুষটির নিয়মিত টেকনিক্যাল সদুপদেশ দিয়ে চলার ঘটনাটিকেও।

আসলে কিছু কিছু কারণে বাঙালির জবানিতে প্রায় সমাসবদ্ধ হয়ে গিয়েছে সুচিত্রা ও উত্তমের নাম দু’টি পাঁচের দশকে জুটির নস্টালজিয়া যদি একটা কারণ হয়, অন্যটা নিঃসন্দেহেই ম্যাটিনি আইডলের ভাবমূর্তি রক্ষার তাগিদে তারকা উত্তমের আড়ালপ্রিয়তার (বামমনস্ক সৌমিত্র ও আমুদে অনিল চট্টোপাধ্যায়কেও হামেশাই যে উপদেশ দিতে শোনা গিয়েছে তাঁকে) ‘সমানুপাতে’ই সুচিত্রার বেছে নেওয়া স্বেচ্ছা নির্বাসনের পরবর্তী ঘটনাপরম্পরাযে দুইকে প্রায়শই সমার্থক ভেবে নেয় বাঙালি। উত্তমের অকালমৃত্যুও ঘটনাচক্রে ইন্ধনই জোগায় যে ভাবনায় (রুপোলি পর্দায় দু’জনার কাউকেই পাওয়ার সুযোগটাই যেহেতু রইল না আর আটের দশকে)যদিও সাতের দশকের চলচ্চিত্রপঞ্জিই সাক্ষ্য দেয় তারকার ভাবমূর্তির মোহ কাটিয়ে মহানায়কের ক্রমশ নিজ শিল্পীসত্তাটির প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী হয়ে ওঠার। বিনা প্রসাধনে ‘যদুবংশ’-র পর্দায় আসাও যার সুস্পষ্ট ইশারাই অসময়ে চলে যেতে না হলে তাঁর নামটি অধুনা সুচিত্রার সঙ্গে কতদূর সমার্থক হয়ে উচ্চারিত হত, সন্দেহই। যেহেতু আটের দশকে বয়সের সঙ্গে মানানসই এক অন্যতর উত্তমকে নিশ্চিত প্রত্যক্ষ করত বাংলা রুপোলি পর্দা। এতকিছুর বিচারে মনে হয়, জনমনে আপন অর্জিত ভাবমূর্তিটার চাইতে অধিকতর মূল্যবান আর কিচ্ছুটি ছিল না সুচিত্রার কাছে। যা বিশিষ্টতাই আভিজাত্যের। পক্ষান্তরে শিল্পীসত্তার পরিপূর্ণতার প্রশ্নটা প্রথম থেকেই গুরুত্ব পেয়েছে উত্তমের কাছে (নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাওয়ার অব্যবহিত পরপরই তপন সিংহর ‘উপহার’-এ পার্শ্বচরিত্রে নেমে পড়াই যার প্রমাণ)যা কিনা খাঁটি শিল্পীর চরিত্রলক্ষণ ব্যক্তিত্বের নিরিখে সুচিত্রা এগিয়ে থাকলেও শিল্পীসত্তার আন্তরিকতার প্রশ্নে তাই অতি অবশ্যই উত্তমকুমার। প্রসঙ্গত, ‘শেষ অঙ্ক’-র নেপথ্য ঘটনাটিকে আলোচনার এই পর্যায়ে পৌঁছে জনৈক পেশাদারের কেরিয়ারের সেই পর্বের বাধ্যবাধকতা হিসেবে মেনে নেওয়াই যায়

বরং বলা যায় অনেকটাই উত্তমের ভাবমূর্তিকে ব্যবহারের বাণিজ্যিক তাগিদ থেকেই সাতের দশকের মূলধারার বাংলা ছবি হয়ে উঠতে পেরেছিল অন্যতর অর্থে সাবালক। বয়সের কারণেই আর কিরীটী, অরুণ বা জয়ন্তদের ভূমিকায় মানাচ্ছিল না সেদিন তাঁকে ‘পিতাপুত্র’-র (১৯৬৯) কেন্দ্রীয় চরিত্রের অফার ছেড়ে দিয়েছিলেন স্বেচ্ছায় কিন্তু ছবিতে তাঁর উপস্থিতিটাও তো কম কথা ছিল না নির্দেশক বা প্রযোজকদের কাছে। দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনেই অন্যভাবে লেখা শুরু হয় চিত্রনাট্য। বলছি ‘ধন্যি মেয়ে’ (১৯৭১), ‘অন্ধ অতীত’ (১৯৭২) বা ‘মৌচাক’-এর (১৯৭৪) মতো সেই ছবিগুলির কথা, যেখানে কোনওভাবেই নায়ক নন উত্তমচরিত্র পরিবারের কর্তা বা মিঠেকড়া অভিভাবকের। কিন্তু চিত্রনাট্যে তাঁর জন্যই বরাদ্দ রয়ে যেত নায়কের চাইতেও ভাবমূর্তিতে বৃহত্তর, প্রায় আক্ষরিক অর্থেই ‘মহানায়ক’-এর ভূমিকা। ধরা যাক ‘অন্ধ অতীত’-এর কথাই। একটা পর্ব অবধি যার চলনে দিব্য রয়ে যায় পাঁচের দশকের তারকা উত্তমেরই বক্স অফিস হিট ছবি ‘সবার উপরে’-র (১৯৫৫) ছায়াসেই পিতার কলঙ্কমোচনে পুত্রের প্রতিষ্ঠানের বিপ্রতীপে অক্লান্ত লড়াইয়েরই পরিচিত আখ্যানপ্রায় সাবেক ছবির অনুসরণেই যখন দশ বছর অতীতের এক হত্যারহস্যের কিনারায় প্রবীরে (চরিত্রায়ণে স্বরূপ দত্ত) মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উঠেছে দর্শক, তখনই ভিন্নতর বাঁক নেয় পরিণতিউপসংহারে স্রেফ এক পঙ্‌ক্তির ‘ক্ষমাপ্রার্থনা’ রেখে মোটরগাড়ি নিয়ে পাহাড়ি পথের বাঁকে লুকিয়ে থাকা চির নিরুদ্দেশের ঠিকানায় বেরিয়ে পড়েই বাজিমাত করে যান জাস্টিস অব্‌ দ্য পিস নির্মলেন্দু রায় (চরিত্রায়ণে উত্তমকুমার)। মহানায়কের ঢঙেই নিমেষে জিতে নেন দর্শকের অনুকম্পা। সতেরো বছর আগে যা বরাদ্দ থাকেনি পাবলিক প্রসিকিউটর সুরেন দাসের (চরিত্রায়ণে নীতিশ মুখোপাধ্যায়) জন্য। সত্য বটে, তারকা উত্তমের ভাবমূর্তিকে প্রাধান্য দিতেই এভাবে সাজানো হয়েছিল চিত্রনাট্য। তবে সেই কাজটা করতে গিয়েই আবার শৈল্পিক উত্তরণে পৌঁছে গিয়েছিল সাতের দশকের বাংলা রুপোলি পর্দা।

যদিও মূলস্রোতের বাংলা ছবিতে উক্ত ঐতিহ্য মোটেই সাতের দশকের সংযোজন নয়। আবার মনে পড়বে আমাদের, তপন সিংহর নির্দেশনায় উত্তম অভিনীত ‘উপহার’-কে। ঘোষিত নায়ককে পেরিয়ে অগ্রজস্থানীয়ের নায়ক হয়ে ওঠার যে গল্পকে সেদিনও প্রত্যক্ষ করেছিল বাঙালি, পিতা কাঙালিবাবুর (চরিত্রায়ণে কানু বন্দ্যোপাধ্যায়) দৌলতে জীবনটা ছারখার হতে বসা কৃষ্ণার (চরিত্রায়ণে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) মুখ চেয়ে দোতলার ভাড়াটিয়া অশোকের (চরিত্রায়ণে উত্তমকুমার) রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়তাকেও অতিক্রমণে। যদিও চিত্রনাট্যের সূত্রে পুরস্কৃত হলেও দর্শকের আনুকূল্য তেমন পায়নি সে ছবি। তাই বলাই যাবে, মহানায়কের পরোক্ষ অবদানেই সাতের দশকে প্রায় ধারাবাহিক সাফল্যের মুখ দেখেছিল বাংলা ছবির উক্ত সাবেক ধারাটি

গণাদার ভূমিকায়


অভিনয় থেকে নির্মিতির রাজযোটক সংসর্গে এই গোত্রের শ্রেষ্ঠতম ছবিটি নিঃসন্দেহে ‘যদুবংশ’। যাতে উত্তমের অভিনয়কে তাঁর জীবনের মহোত্তমও মনে করেন কেউ কেউ। নায়ক না হয়েও চিত্রনাট্য থেকে ‘মহানায়ক’-এর গুরুত্বপ্রাপ্তির নেপথ্য রসায়নকে এ ছবিতে প্রায় চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় ক্যামেরা। যখন পর্দাজোড়া টাইপরাইটারের আড়াল থেকে প্রথমবারের জন্য দর্শকের চোখে উদ্ভাসিত হয় গণাদার অবস্থিতিছবির দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে একদল উচ্ছৃঙ্খল কুলাঙ্গারের সামনে দাঁড়িয়ে দেহমনে নিঃস্ব হয়ে আসা প্রৌঢ় গণাদার চোখের তারায় ঝিলিক দিয়ে যাওয়া চাহনিকে কোনওভাবেই উত্তমের বলা যায় নাএমনকি উত্তমকুমারের কাছ থেকেও অমন চাহনির প্রত্যাশাই করে না বাঙালিযে সোনার পঞ্চপ্রদীপকে ঘিরে সপ্তমীর রাতে সূর্য (চরিত্রায়ণে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়) ও তার দলবলের হাতে প্রহৃত হতে হয় গণাদাকে, পরদিন সেই চারটি ছেলেই চোখের জলে শেষযাত্রায় কাঁধ পেতে দেয় মানুষটাকেএবং, বিমল করের কাহিনির ব্যঞ্জনাকে অতিক্রম করেও পর্দায় এমন এক আবহ নির্মিত হয়ে ওঠে উত্তমকুমারকে ঘিরেই, যার সামনে দাঁড়িয়ে আত্মহনন ক্রিয়াকে কাপুরুষতা ভাবতে স্রেফ মাথা নীচু হয়ে আসে মধ্যবিত্ত বাঙালির। তার আগে ঠাস করে চড় কষাতে ইচ্ছে হয় নিজের গালেই।

এখানেই শিল্পীর সার্থকতা।

এবং তারকা থেকে অভিনেতার অভিজাত বর্ণটি ছুঁয়ে অবশেষে উত্তমকুমারের বাংলা রুপোলি পর্দার অবিসংবাদী মহানায়ক হয়ে ওঠার যাত্রাপথ।

No comments:

Post a Comment