বাক্‌ ১৫৩ ।। তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়


 

একা

 

এই যে আরম্ভ হল তলিয়ে ভাবার দিন, এই যে

স্বপ্নের ভিতর পিতার কুড়ুলে লেগে ছিঁড়ে গেল মাতৃপদ্ম,

এই যে চিন্তার তলায় সারবত্তার নরক চিনতে চিনতে

ধীরে খসে গেছে জীবন, এর তুল্য আনন্দ কোথায়, বলো?

 

যূথবদ্ধতাই তো উন্মাদনা, একাকী তো সুস্থ থাকে মানুষ।

থাকে আয়ুর প্রশ্নে বিহ্বল, জীবিকার ধর্মে সাদা; এই যে

আরম্ভ হল জ্ঞানের মাংসে কীটের সংসার, মাতৃপদ্মে কুড়ুল

কেঁপে ওঠার দৃশ্যে পিতা নিজের শরীর আর শুদ্ধ রাখতে পারছে না,

এই যে ধ্যানের বিপরীতে শুধু ধ্যানই কায়াকল্পের ওম হয়ে ভাসমান,

এর তুল্য সিদ্ধি হয়, বলো?

 

দ্যাখো, নক্ষত্রে নক্ষত্রে ভবিষ্যৎ সীবনের মুগ্ধতায় 

আলো ডুবতে ডুবতে শুধু অন্ধকার ঈশ্বর হয়ে উঠছে,

মায়া কোপাতে কোপাতে যত নীচে নামছি আমরা, কৃষ্ণ সন্তানদের

শব দেখতে দেখতে চোখ ঝলসে যাচ্ছে আমাদের। এরপর

দুঃখের ব্যাখ্যায় দুঃখ, জ্ঞানের ব্যাখ্যায় জ্ঞান, শব্দের ব্যাখ্যায় শব্দ

অহেতুক হতে হতে মুছে যাবে স্বপ্নের প্রস্তুতি।

 

যূথবদ্ধতাই উন্মাদনা, একাকী তো সুস্থ থাকে মানুষ...

 

একাকী এ সুস্থতার অপচয় জীবন জানে না।

 

 

 

আসঙ্গ

 

ফেরার সমস্ত পথ কুঁকড়ে যাচ্ছে অপার্থিব লজ্জায়,

কেন প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছায় শুধু বৃষ্টির শব্দ ঝরে পড়ে আজ?

কেউ জানে না কেন অর্থের সম্ভাবনা ধ্বংস করে কারু,

কেন রিরংসার দীর্ঘ হাড়ে ফুটে আছে পিঙ্গল ফুল,

কেন তুমিই তোমার হত্যার প্ররোচনা হয়ে ফাঁস টাঙাচ্ছ অনঙ্গ শূন্যে,

কেন আমি তোমায় ভালোবাসি, মাথা খাই, বাঁচিয়ে রাখি বারবার!

 

কাদের ফিরে আসার চিহ্নে ভরে আছে সকাল?

কাদের শান্ত, ক্ষীণ হাত থেকে হাতে ঘুরে মরছে বরাভয়?

শোনো, মৃত্যুর বিপরীতে যে পদশব্দের ভ্রম জীবন সন্তাপ করে তোলে,

আজ তার স্পর্শে ফেরার সমস্ত পথ কুঁকড়ে যাচ্ছে লজ্জায়...

 

ভালোবাসি। শুশ্রূষার উপর দিয়ে মাংসল শোক মেষ হয়ে

দৌড়ে যাচ্ছে; এরপর যে গভীর ক্ষতয় ভরে যাবে যাবতীয় কায়া,

তাকে ভালোবাসার অধিক দুঃখ দেওয়া যায়, বলো?

 

শূন্যে অনঙ্গ ফাঁস, ঝুলে আছ মৃত্যুর স্পৃহায়।

ভালোবাসি, মাথা খাই, বেঁচে থাকা স্বীকার করি না।

 

 

 

শোকপ্রস্তাব 

 

হে সংকটাপন্নের দেবতা, বঙ্গদেশীয় কবিদের শোক

তোমার হাস্যকর লাগে। উৎসবে ভরে যাচ্ছে কাঙালের দেশ,

অনুদানে ভরে যাচ্ছে উল্লাসের সম্মেলন, দূর থেকে মন্ত্রঃপূত

রোদ ছুটে আসছে, অন্ধকার বলে আর কিছু নেই, সবুজ আচ্ছন্ন

লীলায় উথলে উঠছে জগতের স্তন... এর ভেতরে শোকের

কঙ্কাল তোমার হাস্যকর লাগে।

 

সামুদ্রিক হাওয়ায় বেড়াতে এসেছি আমরা, আবহমান কবিতার

ইতিহাস নিয়ে গল্প বসেছে আমাদের, এই যে শুরু হল

এর আর থামাথামি থাকবে না; ক্রমশ ভেতরের উগ্রতা ফেনা

চমকানোর ঢঙে উঠে আসবে, কে কার দ্বিতীয় মুদ্রণের তলায়

লুকিয়ে ফেলেছে হিংসার স্রোত, কে কাকে উৎসর্গপৃষ্ঠায়

গেঁথে ফেলার আনন্দে পুরস্কারের মোহ অবধি ভুলে গেছে

এই সহজাত অভিমানের মেদ বালির ওপর থকথক করছে,

আমরা দুনিয়া কাঁপাতে এসেছিলাম, এখন ঠান্ডায় ত্রাসে নিজেরাই

কেঁপে উঠছি তটে, বই থেকে বইয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে অপমানের ছক।

 

হে সংকটাপন্নের দেবতা, বঙ্গদেশীয় কবিদের সংসার তোমার হাস্যকর লাগে।

যে-যার উল্লাস আড়াল করতে করতে প্রশাসনের পায়ে প্রণাম রাখছে, তাকাও!

 

নির্মাণের আলো থেকে খসে পড়ছে দশকের ছাই...

 

 

 

পার্থিব

 

ধীরে পাল্টে যায় বিপদ ঝলসানোর রাত

 

এখানে, অন্ধকারে, মৃত সন্তানদের জীবৎকাল নিয়ে আর

কথা বলি না আমরা। যেন ছিল না এমন কেউ, যেন যতবার

প্রসব ঘিরে কৌতূহলী মুখের শ্রেণি জেগে উঠেছে, ততবার

রমণীর ভেতরের পাতাল খুলে পড়ার গন্ধে দপদপ করে উঠেছে গ্রাম।

 

আমরা যদি না বলি মৃত্যুর কথা, বেঁচে থাকা আদপে সহজ?

 

ধীরে পাল্টে যায় অশ্রু বহনের রাত

 

মৃত সন্তানদের কবরের পাশে জ্যান্ত বৃদ্ধদের ঘোলা চোখ

দৃশ্য ততক্ষণই দৃশ্য যতক্ষণ আকাশ বাস্তব,

স্বপ্ন ততক্ষণই স্বপ্ন যতক্ষণ বাস্তব বা আকাশ কিছুই ধ্রুব নয়।

বৃদ্ধদের পাশে গুটিসুটি কুকুরের ঢঙে বসে আছি আমরা।

হাত কালো হয়ে গেছে গোরস্থানের হাওয়ায়, আর উপায় নেই,

আর রমণের আগ্রহ নেই, যে শ্যামবর্ণ ঈশ্বরের ছায়া বড় হতে হতে

ধর্ম ত্রাস করে দেয়, তার চোখের দিকে তাকালে মুগ্ধতা জাগে কই আর!

 

ধীরে নিভে আসে সময় ঝলসানোর রাত

 

বহু যুক্তি, বুদ্ধির পেশি স্পর্শ করতে করতে ঠান্ডা সন্তানদের শবে

আবার আঙুল ঠেকছে আমাদের। সুর উঠছে, অযাচিত সুর।

 

শোক যত ঝুঁকে আসে, গান তত আলো, শুশ্রূষার...

 

 

 

গমন

 

যাও। দূরে যাওয়ার আগে কাছ ঘেঁষে আসার আয়োজন

শুভ নয়। শুভ নয় খিদে ওঠার আগেই খাদ্যের উপচার।

যাও। যে পথ ক্রমশ তলিয়ে গেছে দিন থেকে দিনে,

যে পথ অস্ত্রের প্রবেশে দুঁ-ফাক হওয়ার অজস্র মনের স্বস্তি নিয়ে

চুপচাপ পড়ে আছে একা, যাও, দ্যাখো সেই পথ তোমায়

শেষ অবধি তোমায় সহ্য করে কি না।

 

এখানে নতুন কথা অনেকে বলেছে, বলবেও সময়ে সময়ে।

একা আমিই হয়তো বুঝি পুনরাবৃত্তির ঐশী টান, পুরনো, রংচটা কথা

বারবার আওড়ে যেতে যেতে আমার মুখ অসাড় হয়ে আসে।

এই যে তোমায় যেতে বলছি, এই যে সংসার মুছে ফেলার প্ররোচনায়

ধাঁধা লাগিয়ে দিচ্ছি তোমার সমস্ত আয়ুতে, এও তো পুরনো জাদু,

অবাক হওয়ার মতো নয়, অথচ কাউকে তো থাকতেই হয় পুরনো শব্দের

দাস, কাউকে নিতেই হয় রক্তস্রোতে উপেক্ষার হাওয়া।

 

যে-কোনও গমনে মন নামে না, অথচ গতি জরুরি।

জরুরি স্থির চরাচরের প্রতিস্পর্ধী পা ঘাসে ডোবাতে ডোবাতে হাঁটা।

শোনো, পদার্থের ওপর পদার্থ খসে পড়ার শব্দ, বোঝো এই ধ্বনি

সৃষ্টির প্রথম থেকে একই, শুধু পাল্টে যাচ্ছি আমরা, আর সেই হেতু ক্ষয়ের শিকার।

 

যাও। একাকী যাওয়ার আগে এত ভিড় সহ্য করা শুভ নয়, মাঙ্গলিক নয়।

 

 

 

বিবর্তন

 

দীর্ঘকাল বনে বাদাড়ে কাটানোর পর যখন সংসার গজিয়ে উঠল

যত্নে কিংবা হিংসায়, তখন থেকেই অসুখের সূত্রপাত।

না, প্রসঙ্গ ধর্মের নয়, কেননা ঈশ্বর বিষয়ে যা প্রচলিত ছিল কৌম

প্রতিষ্ঠার আগে, তার সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই।

ছিল রক্তপাতের দৃশ্যে করুণার ছায়া, মাধুকরী ছাড়া অপর বৃত্তির

দিকে হেসে তাকানোর গোষ্ঠী, ছিল অন্ধকারের নীচে দলবল নিয়ে

বসে থাকা প্রফেটের শৈত্য, যে-কোনও জিজ্ঞাসার পাশে সমর্থনের

উষ্ণতা, ছিল সৈন্যের বেশে সন্ন্যাসীর সমাজ,

আর এখন সেসব গল্পকথার মতো হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়,

কেউ কেউ অবাক হয়, কেউ কেউ অবিশ্বাসে হাসে।

 

দীর্ঘ যুগ সংসার প্রতিষ্ঠার পর আবার বিচ্ছেদের সত্যি ঘন হয়ে উঠছে।

 

এখানে, অসুখে, ভয়ে বেঁচে থাকা লোক বহুকাল আকাশ দ্যাখে না;

দ্যাখে অন্ধকারে খুন হয়ে যেতে যেতে গৃহস্থের কশ টপকে গড়িয়ে গেল

ধর্মচিন্তা, সাংসারিক ব্যথা; বোঝে নরক কখনও ছিল বহু দূরে, বহু অন্ধকারে,

এখন নরক কিংবা স্বর্গের স্থানধর্ম নিভে গেছে, শুধু কালের কুকুর হয়ে

লেজ নড়ে তাদের... তরাসে...

 

আমাদের ছায়া থেকে কৌম যদি ভয়ে সরে যায়,

একা একা মৃত্যুপথে কতক্ষণ উদাসীন যাব?

 

2 comments: