তাহাদের কথা উহাদের কথা
প্রবাদে আছে শ্রাবণে তাহাদের কথা বলতে হয়। এই উদ্ভট প্রবাদ
কে কবে আবিষ্কার করে কেউ জানে না। তবে তাহারা বিদ্যমান। এখনও। এখনকার তাহারা বলতে
বোঝায় দেবতোষ, ঊর্মিলা, মৃণালদের। শ্রাবণের ধারার সঙ্গে দেবতোষ, ঊর্মিলা,
মৃণালদের দারুণ মিল। এই শ্রাবণেই এদের যেন ঈশ্বরভক্তি শতগুণ বেড়ে যায়। শ্রাবণ মাস
এলেই এদের চোখমুখ কেমন পালটে যায়। খাওয়াদাওয়ায় পরিবর্তন আসে। মুখে নিরামিষ ছাড়া
যেন কিছুই ভাল লাগে না।
# # #
আজ ৪ঠা শ্রাবণ। এবার শ্রাবণেও জ্যৈষ্ঠ মাসের গরম। বৃষ্টিও
কম। দেবতোষ শ্রাবণে খুব ভোরে স্নান করে। ভোর চারটের সময় স্নান করে তুলসীতলায়
যায়। তিন-চারটে কচিপাতা মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে গামছা দিয়ে শরীর-মাথা মোছে।
পুরো শ্রাবণ স্নান করেই তুলসীমঞ্চের কাছে এসে দাঁড়ায়। কচিপাতা মুখে দিয়ে গা-হাত-পা
মোছে। এই নিয়মটি বহু বছর আগে দেবতোষ স্বপ্নে দেখতে পায়। দেবতোষ স্বপ্নকে
অত্যধিক গুরুত্ব দেয়। গুরুত্ব দেয় এ কারণেই যে স্বপ্ন কখনও মিথ্যা হয় না।
পুরো শ্রাবণ ধরেই নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখে।
তার বিশ্বাস বন্ধ ঘরে একমনে ঈশ্বরকে ডাকলে ঈশ্বর একদিন না একদিন দেখা দেবেই। যদিও
এইবারের শ্রাবণ দেবতোষের কাছে পঞ্চাশতম শ্রাবণ। কোনও শ্রাবণেই ঈশ্বরের দেখা না মিললেও
বিশ্বাসে চিড় ধরাতে চায় না। বরং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাসও যেন আরও শক্তপোক্ত
হতে শুরু করে। যদি এ বছর শ্রাবণে গৃহবন্দি থেকে ঈশ্বর আরাধনা করে তবে পরের বছর
ঘরের বাইরে যাবেই। কেননা ঈশ্বর সম্বন্ধে দেবতোষের বিশাল বিশ্বাস। জ্ঞান। যেমন
গতবছর গিয়েছিল শ্রাবণ মাসে পাহাড়ে। সেই পাহাড় খুবই গভীর পাহাড়।
জানে একটি পাহাড় শেষ হলেই সেই প্রান্তরেখা থেকে শুরু হয় আর-একটি পাহাড়। আবার সেই
পাহাড় থেকে অন্যটি। দেবতোষের বিশ্বাস পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে থাকে ঈশ্বর। সেই
ঈশ্বরেরও নাকি বহুরূপ।
ঊর্মিলা শ্রাবণের আগেই বাপের বাড়ি থেকে ফেরে।
ঊর্মিলার বাপের বাড়ি ময়ূরগঞ্জে। প্রতি বছর একমাস ধরে বাপের বাড়ি থাকে। এই নিয়ম পুরনো
ঊর্মিলার। ঊর্মিলার ঈশ্বরসাধনা অদ্ভুত। শ্রাবণের আগে একমাস বাপের বাড়িতে থাকতে হয়।
তারপর শ্রাবণ পড়তে না পড়তেই চলে আসতে হয় স্বামীর কাছে। তার কাছে ঈশ্বরদর্শন পাওয়া
যায় স্বামীর বসতবাড়িতে। কিন্তু ঈশ্বরদর্শনের বীজ পোঁতা থাকে বাপের বাড়িতে। সেই
বীজ পুরোপুরি প্রস্ফুটিত হয় স্বামীয় ঘরে। ঊর্মিলার
স্বামী রজত জানে ঊর্মিলা প্রতি বছর আষাঢ়ে চলে যাবেই ময়ূরগঞ্জে। কেননা
ময়ূরগঞ্জের লাল রাস্তা ধরে যখন বাপের বাড়ি যায় তখনই সেই লাল সুরকির রাস্তায়
ঈশ্বরের পদছাপ দেখে। সেই পদছাপ দেখতে দেখতে যখন বাপের বাড়ি পৌঁছয় তখন মনে করে
ঈশ্বর যেন এই বাড়িতেই প্রথম আসে। এমনকি শৈশবে বাবাকে এই নিয়ে প্রশ্নও কম করেনি। ঊর্মিলা
ফ্রক পরে ফুলগাছ থেকে ফুল তুলতে তুলতেও ঈশ্বরের পদছাপ টের পেত।
মৃণাল বিজ্ঞানের ছাত্র। শৈশব থেকেই প্রতিভাবান থাকে
এই শহরের দক্ষিণে। বাদামতলায় মৃণালের নিজের বাড়ি। চাকরি করে বিদেশি কোম্পানিতে।
বেতন মোটা। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের শহরে যে ক’টি উড়ালপুল আছে প্রতিটিতেই
মৃণালের বুদ্ধির ছাপ আছে। কোম্পানি মৃণালের মাথাটাকেই অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়।
সম্মান করে। আগামী বছর যে বিশাল উড়ালপুলটি শহর থেকে মানে রেসকোর্স থেকে শুরু করে
শহর ছাড়িয়ে প্রত্যন্তর গ্রাম বাউরিতে চলে যাবার কথা সেই উড়ালপুলেরও নকশা মৃণালের
হাতে করা। উড়ালপুলটি লম্বায় এক হাজার কিলোমিটার।
কিন্তু মৃণালের বিদেশি কোম্পানি জানে মৃণালকে
শ্রাবণে কোনও কাজে পাওয়া যাবে না। সারা বছর কোনওদিন ছুটি না নিয়ে শুধু মাথায়
উড়ালপুলের চিন্তা। সিম্পল উড়ালপুল কমপ্লিকেটেড উড়ালপুল এইসবেই ডুবে থাকে। ফলে যে
মানুষ তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই সহজ সরল জটিল উড়ালপুল নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাকে সবেতন
একমাস ছুটি দেওয়া একধরনের নৈতিক কর্তব্য। মৃণাল যেহেতু বিজ্ঞানের ছাত্র, যুক্তি
তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সে জানে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন কোম্পানির জন্য খাটা মানেই
একমাস ঈশ্বর-চিন্তায় সম্পূর্ণ ডুবে থাকা। ঈশ্বরের ব্যাপারেও মৃণাল জানে কোনও আজেবাজে
জিনিস মাথায় থাকলে ঈশ্বর-চিন্তায় দুধে জল দেওয়ার মতন হয়ে যেতে পারে। উড়ালপুলের নকশাতেও
মৃণাল কোনও দুধ আর জলকে পাত্তা দেয় না। অর্থাৎ
মৃণাল এতই যুক্তিনিষ্ঠ মানুষ যে কোনও চিন্তায় সে অন্য চিন্তাকে মাথায় ঢোকায় না। সেই
জন্যই ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে মৃণাল এত সার্থক। সফল। বছরের পর বছর বেতন তাই ঊর্ধ্বমুখী।
এই উচ্চ বেতনের জন্যই শ্রাবণে ঈশ্বরের সাধনায় এত হাত খুলে খরচ করতে পারে।
শোনা যায় এই বছর শ্রাবণে মৃণাল যেতে পারে
ডিউকে। ডিউকে ঈশ্বর প্রতি ভোরে কেউ না কেউ দেখতে পাবেই। ঈশ্বরের এই গল্প মৃণাল
শোনে প্রতিবেশী বন্ধু রজতের কাছে। বিমানভাড়া আসা যাওয়া মিলে দশ লাখ। মৃণালের
কাছে ঈশ্বরের জন্য এই অর্থ খরচ নস্যি। আষাঢ়ের
শেষেই বিমানের টিকিট কনফার্ম হয়ে যায়। বিমান ছাড়ার কথা পয়লা শ্রাবণ ভোর চারটের
সময়।
# # #
প্রবাদে আছে উহাদের কথা বলার জন্য কোনও বিশেষ মাস লাগে না। বৈশাখ
থেকে চৈত্র অবধি যে কোনও মাসেই উহাদের কথা বলা যায়। এই উদ্ভট
প্রবাদ কে কবে আবিষ্কার করে কেউ জানে না। তবে
উহারা চিরকালই বিদ্যমান। এখনও। এখনকার
উহারা বলতে বোঝায় রণজিত, শিপ্রা, চঞ্চলদের। এদের
কোনও বিশেষ মাস নির্দিষ্টভাবে প্রিয় না। সব মাসই
এদের প্রিয়। সব মাসেই এরা ঈশ্বর ভুলে নিজের নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে।
দিনের চব্বিশ ঘণ্টার ভিতরে এক সেকেন্ডের জন্য ভুলক্রমেও ঈশ্বর-চিন্তা মাথায় আসে
না।
রণজিত খুব গোবেচারার মতন। দেখলেই মনে হয় ঈশ্বর-চিন্তায়
ডুবে থাকে। আদতে একদমই না। চোখমুখ দেখলে
মনে হয় দেব-দেবী ছাড়া কিছুই বোঝে না। অথচ
রণজিতের সংসার চলে জমিজামা বিক্রি করে। গত তিরিশ
বছর ধরেই এই কারবার করে ফুলে ফেঁপে একাকার। আর জমির
ব্যবসায় সাহায্য পায় রাজনীতির লোকেদের কাছে। পাবেই
না কেন! সব ব্যবসাতেই লাভ করতে করতে গেলে অন্যদেরও কিছু লভ্যাংশ দিতে হয়।
বর্তমানে এই লভ্যাংশ পায় রাজনীতির মানুষজন। ফলে জীবনের এই ব্যস্ততার ভিতর জীবনে
সফলতার জন্য রণজিতের ফাঁকা সময় বলতে প্রায় নেই-ই। ফাঁকা সময় থাকলে মানুষ বাড়িতে
তুলসীমঞ্চ বানায়। সন্ধ্যায় মোম জ্বালায়। প্রদীপ জ্বালায় ইত্যাদি। অবশ্য দেবতার
ওপর বিশ্বাস থাকলে। রণজিতের এই বিশ্বাস তো কোনওদিনও আসে না, কেউ আসার জন্য সাহায্যও করে না। রণজিতের
পিতাও রণজিতের মতন। রণজিতের পিতার পিতাও একই রকমের।
শিপ্রা থাকে অজয়নগরে। বিবাহিতা। পিতার বাড়ি
চন্দনপুর। চন্দনপুর এই শহর থেকে খুব একটা দূরে নয়। মাত্র এক ঘণ্টার পথ। চন্দনপুরে
শিপ্রা বড় হয় কুড়ি ঘরের ভেতর। এই কুড়ি ঘরের সবাই ঈশ্বর বা দেবতা বিষয়ে সম্পূর্ণ
অজ্ঞ। কেননা প্রতিবছর যখন পূজা হয়, ঠাকুর আনা হয় সকলেই কেমন বাঁকা হাসি মুখমণ্ডলে
ঝুলিয়ে বলে এ তো পুতুলপুজো। ঈশ্বরকে পুতুলের সঙ্গে তুলনা করতেই এরা বেশি মজা পায়।
করবেই বা না কেন! ঠাকুর-দেবতারা মানুষের সাজলে নড়েও না চড়েও না। পুতুলও তাই। ওদের
বিশ্বাস পুতুলকে তো মানুষ নাড়ায়। আর মাটির দেবতাদের মানুষই আনে পূজা করতে। শক্ত
ঠোঁটজোড়ায় মানুষই বরণ করার সময় মিষ্টি গুঁজে দেয়। শিপ্রা ছোট থেকেই দেখে আসে
ঠাকুরের ঠোঁটজোড়ায় সেই মিষ্টি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকে। ঠাকুর এক কণাও সেই
মিষ্টি মুখগহ্বরে নেয় না। উলটে লাল পিঁপড়েরা মিষ্টিগুলি খায়। ঠোঁটের কাছে নড়াচড়ে
করে।
চঞ্চল অত্যন্ত গরিব ঘরের ছেলে। তার বাবা রাজমিস্ত্রি। সেই
রাজমিস্ত্রির ছেলে এখন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাশ করে ফুচকা বিক্রি করে।
শান্তিনিকেতনে চঞ্চলের ফুচকা বললেই সবাই এক ডাকে চিনিয়ে দিতে বাধ্য। কিন্তু বিকাল
ঠিক পাঁচটায় চঞ্চল যখন দোকান খোলে তখন কিন্তু কোনও পুজো-আর্চা চলে না।
দোকানের কোনও তাকে আজ পর্যন্ত কেউ কোনও ঠাকুর-দেবতার ফটো দেখে না। ফলে ধূপও জ্বলে
না। অথচ বিনা তপস্যায় বিনা ভক্তিতে চঞ্চলের দোকান রমরমিয়ে চলে। পৌষ মাসে তো
চঞ্চলের ব্যবসা তিনগুণ বৃদ্ধি পায়।
চঞ্চল আসলে ঈশ্বরের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় এক
বিশেষ কারণে। বছর পাঁচ আগে চঞ্চলের বাবা মারা যায়। চঞ্চল সেদিন স্কুলে। বিকাল
চারটের সময় চঞ্চল পিতৃবিয়োগের খবর পায় এলাকার এক কাকুর কাছে। খবর পাওয়া মাত্রই
চঞ্চল বাড়ি আসে। মাকে বাবার পাশ বসে অঝোরে কাঁদতে দেখে মার কাছে গিয়ে পিঠে হাত
দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাবার চুপচাপ শুয়ে থাকা দেহটি দেখতে দেখতে চঞ্চলের দেওয়ালে
টাঙানো মার নিত্য আরাধনার দেবতার দিকে চোখ যায়। চঞ্চল শক্ত মনে ভিতরে ভিতরে
ডুকরে বলে ওঠে মা তো তোমায় নিত্য কত অসুবিধার মধ্যেও বাজার থেকে তাজা ফুল কিনে
এনে পুজো দেয়। তোমারও এইটুকুন ক্ষমতা থাকা উচিত অন্তত মার দিকে তাকিয়ে কাঠ হয়ে
শুয়ে থাকা মানুষটির শরীরে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া। শুনেছি তুমি সব পারো। এমন
কোনও অসাধ্য জিনিস নেই এই জগতে যে তুমি পারো না! মার মুখের দিকে তাকিয়ে দাও না
মানুষটাকে বাঁচিয়ে। পারবে না! সত্যি বলো পারবে না! তবে জেনে রেখো মাও কাল থেকে
অর্থখরচ করে তাজা ফুল আনবে না। পুজো দেবে না। আমাদের মতন এক রাজমিস্ত্রি পরিবারে
পুজো হচ্ছে বিলাসিতা। শখ।
kofal
ReplyDeleteএ পৃথিবীর দুটি সম্প্রদায় - বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী। বলা বাহুল্য - ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্নে। এ গল্পের তাহারা এবং উহারা এই দুই সম্প্রদায়ের। ছন্দোবদ্ধ কবিতার মত উপস্থাপিত দুই শ্রেণির ব্যক্তিবর্গের ন্যারেটিভ দেখিয়ে দেয় এই আস্তিক্য, নাস্তিক্যের ভেদে তাঁদের কর্মক্ষেত্রের কর্তব্যাদিতে কোন অসুবিধা ঘটে না। সম্ভবত যে প্রশ্নটি বেরিয়ে আসে এই দ্বিত্ব থেকে তা' হলো - তবে এই বিশ্বাস- অবিশ্বাসের ফলগত কোন বিভেদ নেই। সেইসঙ্গে তৃতীয় যে দর্শন অনুচ্চারিত কিন্তু উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার নাম অজ্ঞেয়বাদ বা agnosticism, - গল্পের আড়ালে লেখক পাঠককে জড়িয়ে দেন দার্শনিক ধাঁধায় বা ধন্দে।
ReplyDeleteজীবনের একটা মৌলিক বিষয় হল ঈশ্বর। ঈশ্বরে বিশ্বাস অথবা সংশয় অথবা উদাসীনতা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এইরকম একটা প্রশ্ন বা উত্তরকে কেন্দ্র করে গল্প লিখতে চাওয়াটাই একটা দুর্ধর্ষ প্রচেষ্টা। একটএকটা
ReplyDeleteএভাবে ছোটো ছোটো কোলাজের ভেতর দিয়ে একটা সত্যকে খোঁজার চেষ্টা খুব ভালো লেগেছে। খুব ভালো গল্প
ReplyDelete