স্বপ্নের স্রোত ও মায়েরা
ভাদ্র মাসের
চৌঠায় আকাশ মুছে মেঘ এসেছিল।
গোটা দুপুর নিমেষের ভেতর কালো! মোটা মোটা লালচে ভাতের দিকে চোখ ফেলে দেখি, থালার কানা বেয়ে উপচে পড়ছে তারা! এত জলকে জায়গা দিতে গিয়ে ঘর ছাড়া হচ্ছে আমাদের দানা দানা সুন্দর ভাত! বাইরে বাঁশের মাচায় যেখানে গোটা বছরের জ্বালানি তোলা থাকত, ভিজে ছাই হয়ে যাচ্ছে।
মা দ্বিতীয়বার ভাত দিতে এলে, ঠাকুরদি আমাদের পাতের দিকে তাকিয়ে মাকে বলল, আগে জ্বালানিগুলো ঢাকা দেওয়ার জোগাড় করো বউমা।
শুকনো কাপড়ে গিয়ে মা একটা ছেঁড়া ত্রিপল ঢাকা দিয়ে ফিরে এল।
বসে থেকে থেকে বৃষ্টি যখন থামলই না, শুকনো গলায় দাদা বলল, অন্ধকারে যাবি?
তখনও আমার তেমন বোঝার বয়স হয়নি আর এতদিন পর সঠিক মনে নেই, ঠিক কী বলেছিলাম।
শুধু মনে পড়ছে, আমি আর দাদা অন্ধকার একটা ঘরে গিয়ে মেঘ আর মেঘলাকে ভুলে যেতে চেয়েছিলাম।
আমাদের যখনই মন খারাপ হত, আমরা গিয়ে বসতাম ওই ঘরটাতেই।
অন্ধকারে থেকে কিছু দেখতে চাইতাম না।
কেউ আমাদের দেখতেও পেত না।
বাইরে বৃষ্টির ওপর দিয়ে স্রোতের শব্দ ভেসে যাচ্ছে।
আমার গা ছুঁয়ে দাদা বলল, আজ শনিবার না! বেশ মনে আছে, সেইসময় প্রতি শনিবার পাড়ায় পাড়ায় একটা ঘোড়াকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে তার সহিস ঘুরে বেড়াত।
কোনো নাম ছিল না সহিসটার।
পাড়ার সবাই তাকে ঘোড়াবালা বলেই ডাকত।
আমরাও। অথচ ডাকলে কোনো শনিবারেই তার সাড়া পেতাম না।
চোখে এক অদ্ভুত অহংকার ছিল লোকটার! একটা লোমশ পুষ্ট ঘোড়ার মালিক যে! চাল, পয়সা যে যা দিত, সেগুলো যেন তার পাওনা ছিল।
ঘোড়াবালা কারও সঙ্গে দুটো সহজ কথা বলত না।
তবু পাড়ার আর গ্রামের লোকের কাছে তার কত খাতির! কত কত মিষ্টি সম্পর্ক বানিয়ে লোকেরা তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করত!
আমি আর দাদা চোখ পেতে রাখতাম।
ঘোড়াটার পেছনে পেছনে কতদূর চলে যেতে চাইতাম! অথচ সেই গন্ধটা! আমাদের নাকে ঘোড়ার গন্ধটা ভরে উঠলেই, কেমন শিথিল হয়ে ঢলে পড়তাম আমরা।
মানুষ ঘুমিয়ে পড়ার আগে যেমন ঘুমোয়! সেইটুকু সুখ ছিল আমাদের।
ঘোড়া হেঁটে হেঁটে কখন অদৃশ্য হয়ে যেত, আর আমরা রাস্তায় হুঁশ হারিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম।
প্রতি শনিবার বাড়ি ফিরে আমি আর দাদা ওই অন্ধকার ঘরটাতে বসে থাকতাম।
অমন একটা লোমশ ঘোড়া না থাকার জন্য মনে মনে কষ্ট পেতাম! সারাদিন চোখ আর নাক ভরে গন্ধ নিতে পারতাম! সুখে সুখে ঘুমের আবেশ!
তবুও তো সপ্তাহে অন্তত একদিন কিছু সময়ের জন্য একটা দুর্দান্ত সুখ পেতাম! সেদিন তারও উপায় নেই! বৃষ্টির ধোঁয়া আমাদের চোখের রাস্তা আটকে রেখেছিল।
গভীর ঘুমের ভেতর ঘোড়া আর বৃষ্টি কখন থেমে গেল জানতে পারিনি।
কিন্তু পরদিন সকালে এক অন্য বিপদ! ঠাকুরদির চিৎকারে ঘুম ভেঙে দেখি ঘোলা জলে আমাদের ঘরের সামনের খামারটা ডুবে গেছে! বাবা, মা, ঠাকুরদি ঘরের জিনিসপত্রগুলো তুলে তুলে রাখছে তক্তপোশের উপর।
তবুও তাদের চোখে আতঙ্ক। জল নাকি যেভাবে বাড়ছে, এই উঁচুতে উঠেও সবকিছু ছুঁয়ে দিতে পারে! সামনের উঁচু রাস্তাটা পর্যন্ত জলে ডুবে গেছে।
সেই রাস্তা ধরে লাঠি নিয়ে যারা আসছে, সবাই বলছে, ‘গোপালপুরের বাঁধ ভেঙে গেছে।
সব ভেসে যাবে!’
পাড়ায় শুধু আমাদের ঘরেই গরু ছিল না।
গরু থাকলে নাকি বন্যার সময় মায়া বাড়ে আর লোভ ত্যাগ করতে হয়।
সেদিন দুয়ারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, রণজিৎ দাদু অসহায় মুখে তাদের দু' বিয়ানি লাল গাইটার গলা থেকে দড়ি খুলে জলে ভাসিয়ে দিল! সারারাত ধরে দুধ জমে টানটান বাঁটগুলো ডুবে গেল ঘোলা জলে! তাকিয়ে রইলাম গাইটার সাঁতরে ফেলে যাওয়া জলে আর সেদিনই জেনেছিলাম বিপদে দুধের রঙও কেমন ঘোলা হয়ে যায়!
নিমেষের মধ্যে জল ফুলতে ফুলতে আমাদের উঠানে এসে ঠেকল।
আমরা দু' ভাই তেমন কোনো শব্দই পাইনি কিন্তু আমাদের ঠাকুরদি গোপালপুরের দিকে কান খাড়া করে বলল, ‘জলের গর্জন শুনছু!’
তার কথায় আমরা যেই একটু ভয় পেলাম অমনি আমাদের কানগুলো গাছের সমান উঁচু ঢেউয়ের তেড়ে আসার শব্দে ভরে গেল!
বেলা বাড়তে বাড়তে জল ফুলে উঠছে।
পঞ্চায়েতে না দাঁড়ানোর জন্য নাকি যাকে প্রকাশ্যে নেতারা হুমকি দিয়ে খাটো করে দিয়েছিল, আমাদের সেই বাবা উঁচু হতে হতে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল জলের ভাসা-তল।
সেই থেকে আমরা দু’ ভাই গোপালপুরের সাদা মাঠের দিকে তাকিয়ে আছি।
কত জ্যান্ত গরু সাঁতরে ভেসে আসছে! চোখগুলো করুণ করে তাকিয়ে থেকেও শেষ অব্দি ফল পেলাম না।
আমাদের পাড়ার শেষে জোড়া তালগাছের পাশ দিয়ে গরুগুলো ভেসে চলেই গেল নীচের দিকে! এরই মাঝে দাদার নাম ধরে কে যেন ডাকল!
সেই সকালটা আজও স্পষ্ট মনে আছে! আমরা দু’জনেই ঘরের চারপাশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে থইথই জলের দিগন্তে তাকিয়ে ছিলাম।
পশ্চিম মাঠের যে জায়গাটায় একা একটা বেচকুলের গাছ দাঁড়িয়েছিল, তাকে পাশ কাটিয়ে একটা কলাভেলা আর একটা দৈবাৎ ডাক এগিয়ে আসছে! নিমেষে আমাদের সারা শরীরের ভেতর দিয়ে ব্যানা বাতাস বয়ে গেল।
আমি বেড়া ছেড়ে ছুটে এসে ঠাকুরদিকে জড়িয়ে ধরে বলি, ‘ঠাদি, ভ্যালায় চেপে কোথা যাবা হয়!’
ঠাকুরদি বিরক্ত মুখে ভিজে মাটি থেকে পা ছাড়িয়ে খিটখিটে গলায় বলল, ‘সগ্গে! যাবি!’
এইসব কথার ফাঁকে কখন মায়ের পায়ে একটা সাপ এসে জড়িয়ে ধরেছে।
মায়ের কাছ থেকেই আমরা সাপকে ভয় পেতে শিখেছিলাম।
অথচ সবাইকে অবাক করে মা কেমন করে সাপটার লেজে ধরে দূর জলে ছুঁড়ে ফেলল!
কিছুক্ষণ পর সেই ভেলা এল।
ঘরের সামনের জলখামারে দক্ষিণপাড়ার প্রলয় দু’ পা ফাঁক করে ভেলার উপর লগি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! পেটাই করা স্বাস্থ্য।
দাদাকে সঙ্গী করতে চায়।
বাবা ঠাকুরদি ভেলার উপর হেলায় ভাসতে থাকা প্রলয়কে দেখে কোঁকাতে থাকে, ‘তোর কি লজ্জাউ নাই! একটা চাষিঘরের ছ্যানা হয়ে তুই ধানগাছ মাড়ি মাড়ি ভেলা চালাউঠু!’
‘সব ধান ডুবে গেছে দাদা।
হেজে যাবে মনে হয়…’
মা প্রলয়কে থামিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল, ‘আজকালের ভিতরে
জল নেমে গেলে সব গাছগুলাই জেগে উঠবে প্রলয়।’
দাদা আর আমি হাত ধরাধরি করে প্রলয়ের ভেলাটার দুলুনি দেখতে দেখতে তলিয়ে যাচ্ছি, অমনি ঠাকুরদি মায়ের দিকে ফিরে বলল, ‘বউমা
ছ্যানাগুলাকে লিয়ে তুমি তমার বোনের ঘর চলে যাঅ।’
প্রলয়ের ভেলায় হয়ে পাকা রাস্তায় যাওয়ার সময় মা বারবার আমাদের ফেলে আসা ঘরের দিকে তাকিয়েই ছিল।
প্রলয়কে সাবধান করে বলছিল, ধানগাছের উপর যেন লগি না পড়ে! অথচ প্রলয়ের কাঁচা হাতের লগির টানে একটা ন্যাতানো ধানগাছের ডগপাতা উঠে এল ভেলায়! স্পষ্ট দেখলাম, যেন কাউকে লুকিয়ে মা ডগপাতাটা মুখে একবার বুলিয়েই জলে ফেলে দিল!
শোলাবেড়ের মাঠ ধরে পিচরাস্তায় উঠতে উঠতে আমাদের ভেলা ভরে উঠল অজস্র ব্যাং আর ফড়িংপোকায়! আমি আর দাদা তাড়াতে গেলে মায়ের স্পষ্ট বাধা! ভেলা থেকে যখন বাসের রাস্তায় নামলাম, এর পরের পথ চেনার জন্য মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলাম, কোথায় ছিল মায়ের ডান দিকের গালে এত বড় একটা সাদা দগদগে ভাতুড়!
রেলবাঁধের উঁচুতে উঠতেই দেখতে পেলাম উলটোপাশের গড়ানে একটা খাল।
আর খালের ওপারে আমাদের কাজুমাসি দাঁড়িয়ে আছে! ঠকঠকে শুকনো পা।
সারা মুখে ঘরের ছায়ার চিহ্ন! এইটুকু দেখেই আমাদের মুখ স্বস্তির হাসিতে ভরে গিয়েছিল।
আমাদের সামনে হাঁটুজলের খাল আর সাঁকো দেখিয়ে মাসি চোখ পাকিয়ে বলল, ‘দেখে আসবি, কুমির আছে!’
মা একটু ভয় পেল।
কিন্তু আমি বা দাদা স্বপ্নেও কোনোদিন কুমির দেখিনি বলে নির্ভয়ে সাঁকো পার হলাম।
পেছনে পেছনে আমাদের মা।
মাটির দোতলা বারান্দা বাড়ি।
একটা জপমালা নিয়ে বসে আছেন মাসির শ্বশুর।
গুনতে গুনতে চোখ খুলে আমাদের দেখেন।
ভেলায় উঠে আসা ব্যাংগুলোকেও আমাদের মা এমন চোখে দেখছিল।
মাসির পেছনে পেছনে মা ভেতরে গেল।
আধো আলোয় দাঁড়িয়ে দাদা চারদিকে তাকিয়ে কী যেন একটা হিসেব করে নিল! আমাকে বলল, ‘আমরা উত্তর দিক থেকে এসেছি।’
একটা নতুন জায়গা, সূর্য ডুবে গেছে কখন! সামনে একটা আস্ত সন্ধ্যা আর রাত পড়ে আছে।
তাই দিকগুলো ঠিক করে নেওয়ার দরকার ছিল।
আমি দাদার কথা শুনে একবার উত্তরে তাকালাম, গাছের পাতা পড়া রাস্তাটা ততক্ষণে প্রায় অন্ধকারে ঢেকে গেছে আর রাস্তার শেষে গোঁ গোঁ শব্দ তুলে একটা ট্রেনের আলো হুশ করে চলে গেল।
‘মা, ও মা!’
কোন এক ঘরের ভেতর থেকে মা সাড়া দিয়েছিল! এখনও বাজি ধরে বলতে পারি, জীবনে ওরকম সন্ধ্যা আমি কোনোদিনই কাটাইনি।
মাসিদের এতবড় ঘর! কৃত্রিম আলোর ক্ষমতায় কুলোত না সব ঘরগুলোকে আলো করে রাখার।
যে ঘরে যখন মানুষ থাকত, তখন সেই ঘর আলো।
সেই একটা আলোর রেখা ধরে আমি আর দাদা মা পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম।
আমরা যেতেই তাদের কথা শুকিয়ে গেল।
রয়ে গিয়েছিল শুধু মায়ের সায় দেওয়া ঘাড়ের বাঁকা ভাবটুকু।
মেসো এলেন এক হাঁটু কাদা পা নিয়ে।
হয়তো আগে থেকে জানতেন না আমাদের আসার কথা।
তাই একটু অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাতেই, মা গড়গড় করে বলে গেল, ‘কাল দুপুরবেলা পাড়ায় রটে গেল, গোপালপুরের নদীপাড়ে নাকি খুব উর্বর একটা জমি পাওয়া গেছে! ভাত ফেলে সবাই ছুট দিল।
অ্যাদের বাবাউ! ঘুরে আইল বেলা গড়িয়ে।
এসে আর একটাউ ভাত মুখে তুলতে পারলনি! ত ত করে বলল, মেঘলা আলো পড়েউ সেই জমিটার পলি নাকি চকচক করতিছে! আর ক’টা দিনের ভিতরেই নাকি আমাদের পুরা মাঠটায় পলি পড়ে সরেস হয়ে যাবে! ওরকম জমিনে চাষবাস করবার জন্য মোর ব্যাটাদু’টাকে এখিনে লিয়ে আসছি দিদি। অদেরকে একটু চাষটা শিখি দিবেন জামাইবাবু…’
আমরা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম! মা কি মিথ্যে বলল নাকি স্বপ্নের সত্যি! মেসো তার পায়ের লোম থেকে শুকনো হয়ে যাওয়া মাটি ছাড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
কতদিনের সম্পন্ন চাষি ছিলেন মেসো, অথচ কেন যে ওরকম মুষড়ে কঁকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন! যেন বিড়বিড় করে বললেনও, ‘মাটি আর ধানই কি সব!’
মাসির বাড়ির দোতলার ছাদে হাঁটার কথা মনে পড়লে এখনও আমার পা ফেলতে ভয় করে।
যেন এখুনি এই জায়গায় পা ফেললে আমার পা-সহ আমি তলিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাব! দাদা আর আমি হামাগুড়ি দিয়ে ছাদের সেই বিছানায় গেলাম, যেখানে আমাদের শুতে বলা হয়েছিল।
উত্তরদিকের জানালা দিয়ে অন্ধকার আর থেকে থেকে ট্রেনের শব্দ আসছে।
শুয়ে পড়ে দাদা আমাকে বলল, ‘আচ্ছা মা এরকম কেন বলল! আমাদের তো সব ডুবে গেছে! এতক্ষণে হয়তো ঘর, বাবা, ঠাদি কোথা হারি গেছে!’
আমি চুপ করে মরার মতো পড়ে রইলাম।
দাদাকে কোনো উত্তর দিতে পারলাম না।
চোখ বন্ধ করলে মনে হচ্ছিল কোথায় তলিয়ে যাচ্ছি! ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বেনা জলের স্রোত! শ্বাসরোধী তবু শীতল।
অথচ চোখ বন্ধ করে থাকলেই যেন সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারব! তারপরেও দাদা আর কী কী বলেছিল, আমাকে শোনানোর মতো করে, আমার কাছ থেকে কিছু জানার আশায়, আজ আর সেসব কিছু মনে নেই।
সকালে ঘুম ভেঙে দেখি, দাদা বিছানায় এলোমেলো বসে আছে।
‘কী হইছে! কী হইছে বল না!’
দাদাকে নাড়া দিতে গিয়ে দেখলাম, একটা পোকা আলোর রাস্তা ধরে আমাদের বিছানায় খেলছে।
শুকনো হেরে যাওয়া মুখ করে জানালাটা দেখিয়ে দাদা বলল, ‘এটা উত্তর দিক নয়!’
কিছু সময়ের জন্য আমিও চুপ করে গিয়েছিলাম।
মাথাটা গুলিয়ে উঠল।
কোনোরকমে নীচে নেমে সকালের মা ডাকতে যাব, আমার সামনে এসে ঝুঁকে দাঁড়ালেন মাসির শ্বশুর।
তখনও তাঁর হাতে জপের থলি।
‘তমরা কাল অত রাত অব্দি জেগেছিল কেন? এখন তমাদের ঘুমানার সময় ত! ঘুমি ঘুমি শুধু স্বপ্ন দেখব।’
তারই মধ্যে দাদা কখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
দু’জনে গিয়ে মায়ের দিকে তাকাতেই তলে তলে আমাদের আঘাত দিয়ে মা পূর্বদিকটা দেখিয়ে দিল!
ততদিনে আমাদের দিক নিয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই।
যখন আমরা ওই পূর্বদিকেই একটা ঘর আর কিছু আতাগাছ দেখলাম।
গাছে ফলে থাকা থাকে থাকে আতা দেখলেই আমাদের মাথার ভেতর থেকে সব সন্দেহ দূর হয়ে যেত।
মনে হত, পূর্বদিক মানেই সূর্য আর আমাদের প্রিয় আতার থোকা।
আমাদের চোখ দেখে মাসি একদিন বলেছিল, কোনো এক ডাক্তার তার এই ঘর আর আতাগাছের সারি ফেলে অসুস্থ মানুষের পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ান।
সবার চোখ এড়িয়ে আতা তুলে আনতে গিয়েও থমকে যেতাম! কেউ কোথাও থাকত না! অথচ মনে হত, শুধু এই ঘর আর আতার টানেই যেন ডাক্তারবাবু রোগী ফেলে এখনি ছুটে আসবেন! আতার প্রতি আমাদের যে টান, তিনি সেই টান উপেক্ষা করবেন কী করে! এই আতাগাছগুলো দেখা থেকে মা বারবার করে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, মানুষের রোগব্যাধি আর অভাবে আতা একটি মোক্ষম ওষুধ।
‘সব সময় তুমি আতা হাতে লিয়ে এরকম তাকি থাকো কেন মা!’
অপ্রস্তুত হয়ে মা অন্ধকার খুঁজে খুঁজে চলে গেল।
আমরা সেদিকেই তাকিয়ে রইলাম।
অন্ধকারে মা কি উত্তর খুঁজতে গেল!
মা...
মা…
নিঃসাড় অন্ধকার থেকে চোখ ফিরিয়ে আমরা মাসির শ্বশুরের দিকে চেয়ে রইলাম।
তিনি তখন ক্লান্ত আঙুলে জপমালা শেষ করে স্থির চোখ মেলে আছেন।
যেন তিনি এতক্ষণ মালা গুনতে থাকার সহজ অভ্যাসের ভেতর কত কত স্বপ্ন দেখে ফেলেছেন।
তাঁর চোখে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকা কোনো অসুখ তৈরি করল না।
মাসি সন্ধ্যা দেখিয়ে এসে প্রণাম করলেও তিনি তেমনই অনড়।
এতদিনে ডাক্তারবাবুকে আমরা একবারও দেখলাম না।
পরের দিকে সেই নিয়ে আর ভাবতামও না।
কারণ ডাক্তার নয়, আমরা আসলে আমাদের মায়ের কাছ থেকে আতাগুলো লুকিয়ে রাখতে শুরু করেছিলাম।
দিনের যখন তখন মা নিজে গিয়ে ঝুলে থাকা আতার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকত! অবাক হতাম, এত নির্জন সুযোগ পেয়েও মা কেন কয়েকটা আতা নিয়ে আসছে না! জানতে চাইলেই মা আমাদের বোঝাতে বসত, ‘আতার স্বপ্ন দেখলে মানুষ সম্পন্ন হয়।
সুখী জীবন পায়।
সারাদিন চোখের সামনে আতা ধরে রাখলে স্বপ্নে আতা আসে রে...’
শুকিয়ে যাওয়ার কালে আমরা বাড়ি এলাম।
কাদা মাঠে হেজে যাওয়া ধানের পাশে পাশে পা রেখে আমি আর দাদা কত হাঁটলাম, অথচ সেই ভেলাটা দেখতে পেলাম না! এতদিন মাসির ঘরের ছাদে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটার সময় আমরা কেবল সেই ভেলাটার কথাই ভেবেছি! খুঁজে খুঁজে প্রলয়কে যদিও বা পেলাম, সে বলল, ভেলার কথা তো সে দিব্যি ভুলে গেছে! আরও বলল, ‘ভেলা তো শুধু জল চেনে অথচ মানুষকে যে সব চিনতে হয়!’ বলে ব্যস্ত হাত নেড়ে ধানগুলো কাটার ইশারা করে সে ধানিরঙে মিলিয়ে গেল! মানুষ এই ক’দিনে এত বদলে যেতে পারে!
মাসিঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা অব্দি মায়ের সাক্ষাতে আমরা কোনোদিন একটাও আতা মুখে তুলতে পারিনি।
প্রতিবার আমাদের বাধা দিয়ে বলেছে, ‘আতাগুলা শুধু ভালো করে দেখ।’
দেখেছি, মায়ের আবদারে বাবা এক-একদিন কাঁচা আতা এনে দিত।
মাঝে মাঝে হয়তো স্বপ্নও দেখতে পেত মা! আমরা কী হব, কী হলাম করতে করতে প্রথমে একদিন ঠাকুরদি, তারপর অনেকদিন ধরে শোক দিয়ে বাবা আমাদের ছেড়ে গেল! মা বেঁচেবর্তে থেকে গেল তেমনই— আতার বায়না নিয়ে।
বাবার জন্য দু’-চারদিন শোক করে— শোক কাটিয়ে একদিন সকালবেলা, যেন মা সারারাত জেগে একটা পরিকল্পনা করে রেখেছিল, আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মোকে আজকেই একটা আতা এনে দে…’
এখন আমরা প্রলয়ের কাছ থেকে ভেলা বানানো শিখে গেছি।
লটকে হেজে যাওয়া পাশাপাশি তিন-চারটা ধানের গোজ একসঙ্গে বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারি।
এখন স্পষ্ট বুঝতে পারি মায়ের দিন দিন বেড়ে ওঠা ধপধপে সাদা ভাতুড়ের মানে।
নিশ্ছিদ্র ঘুম আর ভরাট খোঁপা নিয়ে মা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালে কিছুদিন আগে অব্দিও আমরা তাকে একটা আতা এনে দিতে পারতাম।
এরই মাঝে আমাদের রাষ্ট্রপতি একদিন ঘোষণা করলেন, ‘বৃক্ষ সংরক্ষণের
ব্যাপারে আমাদের হুঁশ আছে।
কিন্তু একটি বিশেষ কারণে বাড়ি বাড়ি থেকে আতাগাছগুলো কেটে ফেলতে হবে।’
আমাদের চোখের আড়ালে রাখা প্রতিবেশীদের আতাগাছটাও দেখলাম একদিন কাউকে না জানিয়ে মাননীয় রাষ্ট্রপতির আদেশ মেনে নিল! সেই আদেশের দিন থেকে গুনে গুনে তিনদিন বেঁচে ছিল আমাদের মা।
ওই তিনদিনের প্রতি মুহূর্তে আমরা হাটবাজার এক করে আতা খুঁজেছিলাম! চারদিনের দিন সকালে আমরা দু’ ভাই দেখলাম, আমাদের মা ভ্রূ কুঁচকে বড় বড় চোখ খুলে মারা গেছে! মানুষ তন্নতন্ন করে কিছু খুঁজতে গেলে যেমন হয়, তেমন।
কিংবা রাষ্ট্রপতির আদেশের মর্ম বুঝতে পারলে যেমন!
No comments:
Post a Comment