বাক্-স্বাধীনতা : ব্যক্তিগত দর্শন -- ত্রয়োদশ পর্ব
'দ্বন্দ্বই সমস্ত বস্তুর জনক,
প্রত্যেকটি বস্তুর মধ্যেই রয়েছে বিরোধী নীতি।'– এই আদর্শ দিয়েই শুরু হয়েছিল মানবসভ্যতার প্রথম অনুসন্ধান। প্রথমে পার্থিব
জগতের খোঁজ, আগুনের আবিষ্কার, চাকার
ব্যবহার, লোহার ব্যবহার এবং তার পরবর্তী সমস্ত সত্তার চিরন্তন
খোঁজ। গ্রিক দার্শনিক প্লেটোই সর্বপ্রথম বুঝতে পেরেছিলেন পরস্পরবিরোধী নীতির সংঘাত
ও সহাবস্থানই হল বস্তুর অস্তিত্বের ভিত্তি। প্লেটো তাই হেরাক্লিটাস অপেক্ষা কৃতী দার্শনিক।
প্লেটোর এই ধারণা সম্পর্কে হেগেল বলেছেন, 'The platonic philosophy first
gave the free, scientific and thus at the same time the objective form to
Dialectic...In his more strictly scientific dialogues Plato employs the dialectical
method to show the finitude of all hard and fast terms of understanding. Thus
in The Parmenides he deduces the many from the one, and shows nervertheless
that the many cannot but define itself as the one. In this grand style did
Plato treat Dialectic.'
ব্যক্তির মধ্যেই
থাকে আত্মচেতনা, যা শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান
ও দর্শনের মৌলিক বৈশিষ্ট্য নির্মাণ করে। চেতনা, যা পৃথিবীতে
সমস্ত সংশয়কে খুঁজে বের করে আনে। সেই সংশয় সম্পর্কের হতে পারে, প্রতিষ্ঠার হতে পারে, আধিপত্যের হতে পারে,
হতে পারে কোনও বিচারের কিংবা আবিষ্কারের, সমস্যা ও সীমাবদ্ধ ফলফলের কিংবা সংশয় একজন ব্যক্তির বেঁচে থাকা নিয়েও হতে
পারে। চেতনা সর্বদা আত্মচেতনার সম্মুখে একটি কাজ তুলে এনে রাখে এখন মানুষের বিবেচনাকে
প্রশ্নের মুখে ফ্যালে। যেহেতু চেতনা স্বাধীন নয়, তাই কী বিষয়ের
ওপর মানুষের সংশয় তৈরি হবে বা সেই সংশয়ের কী সমাধান থাকবে তা আগে থাকতে ব্যক্তির মধ্যে
তৈরি থাকে না। কাজেই ব্যক্তি চিন্তিত হয় অর্থাৎ একটি পরিস্থিতিগত পরীক্ষা দিয়ে নিজের
ইচ্ছাকে বস্তুর ওপর আরোপিত করে কর্তৃত্বময় একটি সুখ পেতে চায়, যাকে সে বেঁচে থাকার আসল অর্থ বলে দাবি করে। যেহেতু ব্যক্তিমাত্রই নিজের
ইচ্ছা বস্তুর ওপর আরোপ করতে পারে, যা কেবল ব্যক্তির স্বার্থপ্রসূত,
তাই বস্তুর মধ্যে নিহিত সত্য সে দেখতে পায় না। নিজের ধারণাকেই বস্তুর
সত্য বলে সে বিশ্বাস করে। ব্যক্তি হিসাবে সকল মানুষ সমান, তারা প্রত্যেকেই বস্তুর মতো আচরণ করে, কিন্তু ক্ষমতা,
দক্ষতা, কৌশল এগুলির প্রত্যেকটিই মানুষ প্রয়োগ
করে নিজের স্বার্থপূরণের তাগিদ অনুযায়ী। সেই ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রচালনা করে তখন একটি
অস্তিমান রাষ্ট্রের অনেক ত্রুটি তৈরি হতে পারে। হেগেল একটি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ব্যক্তিসত্তার
সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে রাষ্ট্র সম্পর্কিত কয়েকটি স্তরের কথা উল্লেখ করেন:
প্রথমটি হল: সংবিধান
একটি এমন নীতি প্রয়োগ, যা রাষ্ট্রব্যবস্থায় সকল নাগরিককে
কর্তব্য পালনে সচেষ্ট করবে তথাপি কোনও নাগরিককে সেই নীতির দাসত্ব করতে হবে না। সেই
নীতিও প্রয়োজনে পরিবর্তিত হতে পারে যদি তা সমষ্টির ও ব্যক্তির সত্যসাপেক্ষে বিরোধী
হয়।
দ্বিতীয়টি হল: আন্তর্জাতিক আইন
একটি এমন নীতি যা বিশ্ব নাগরিককে আশ্বস্ত
করবে। যা সমস্ত রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিগুলোকে স্বীকৃতি জানাবে কিন্তু নিজের সত্য থেকে
তা কখনও লঙ্ঘিত হবে না।
তৃতীয়টি হল: বিশ্ব ইতিহাস
পৃথিবীতে যা ঘটবে, তার সত্যগুলো কখনোই মুছে যাবে
না। সেই ইতিহাস থেকে মানুষকে শিক্ষা নিয়েই যাবতীয় নীতি তৈরি করতে হবে, কিন্তু সেই ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষাই মানুষ অর্জন করতে পারবে না বলেই মানুষের
প্রতিটি ভূমিকাই অন্ততকাল ঐতিহাসিক ভুল রচনা করে যাবে এবং মানুষকে ভুগতে হবে।
অর্থাৎ, ধারণার বাহ্যিক রূপ হল প্রকৃতি,
দেশ হল প্রকৃতির মূল ভিত্তি। স্বয়ং বাহ্যিকতাই হল দেশ। দেশ সমসত্ত্ব,
ছেদহীন, বিভেদহীন। কান্টের ধারণা অনুযায়ী
দেশ আকারমাত্র। কিন্তু হেগেল তা অস্বীকার করেন। হেগেলের মতে দেশ ও কাল অবিচ্ছেদ্য।
দেশ ও কালের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয় গতিতে, গতি জড়ের সঙ্গেই
যুক্ত। জড় দেশ ও কালে থাকে। কালের মধ্যে জড়ের স্থান পরিবর্তনই হল গতি, বিদ্রোহ, যার সূচনাকে, ধারণাকে চিরকাল আক্রমণ করে শিল্প, সাহিত্য ও দর্শন।
No comments:
Post a Comment