ভাবছি বিনয় মজুমদারের কথা। তাঁর অকাদেমি পুরস্কার
প্রাপ্তির খবর যখন এল,
এক তরুণ কবি তাঁকে খবর দিতে গিয়ে দেখলেন ঘর বন্ধ করে অন্ধকারে উলঙ্গ
হয়ে শুয়ে আছেন বিনয়- যেন মায়ের কোলে শুয়ে আছে শিশু। খবর তিনি আগেই পেয়েছেন। পুরস্কারকে এভাবে বিদ্রুপ
করতে আর কেউ পারেননি বাংলা কবিতায়। প্রতিষ্ঠানকে এমন পদাঘাত করতেও কেউ পেরেছেন কি? অথচ,
তিনি নাকি ছিলেন অপ্রকৃতিস্থ! জীবনের শেষ পর্বে
যে কবিতা তিনি লিখেছেন নগ্ন নির্জন পয়ার ছন্দে, প্রতিদিনের বেঁচে
থাকার এবং সাদামাটা জীবনের নিতান্তই তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর বিষয়গুলোকে নিয়ে, বিশেষ করে ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ কাব্যগ্রন্থে, তার তুলনা পৃথিবীর কবিতায় নেই। অথচ বাঙালি তাঁর প্রথম
পর্বের জীবনানন্দীয় কবিতার লাবণ্যেই মোহিত হয়ে রইল! আমি বলব, এ তাঁর মহত্ত্বের প্রতি তাঁর জাতির চরম অবিচার। কিংবদন্তি কবি। গণিতজ্ঞ কবি বিনয়। উন্মাদ কবি বিনয়। কবিতার আগুনে পুড়ে ছাই
হয়ে সেই ছাই থেকে উঠে আসা ফিনিক্স হলেন বিনয় মজুমদার। তাঁর বিপুল খ্যাতি, তাঁর অতুলনীয়
জনপ্রিয়তা… তাঁর অবিনশ্বরতার সামনে তুচ্ছ হয়ে যায়। গায়ত্রী চক্রবর্তীকে
তিনি কি সত্যিই ভালবেসেছিলেন? নাকি শুধুই সারা জীবনের অবসেশন? এই প্রশ্নের উত্তর কোনোদিন জানা যাবে না। কখনো তাঁর কবিতাকে বলা
হয়েছে অশ্লীল। কখনো
বলা হয়েছে অসংলগ্ন প্রলাপ। কবিতার বাঁধাধরা পথের বাইরে একবার বেরিয়ে যেতেই বাংলা
কবিতার প্রতিষ্ঠান আর তাঁর দিকে তাকাতে চায়নি- যেমন বললাম, কেবল
প্রথম পর্বের কবিতারই গুণগান হয়েছে। আমি যখন সদ্য কবিতা লিখতে
এসেছি, বিনয় মজুমদারের জীবনের শেষ কয়েকটা বছর তখন, একজন খ্যাতনামা
কবি-সম্পাদক আমাকে বলেছিলেন বিনয় সত্যিকারের পাগল নন,
তিনি পাগল সেজে আছেন। আমার মনে হয়েছিল, সত্যিকারের পাগল
কাকে বলে? ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কৃতী ছাত্র,
গণিতে তুখোড় বিনয় মজুমদার কেবল কবিতাকে ভালবেসে কেন এক প্রান্তিক জীবন
বেছে নিলেন? কী দিল তাঁকে কবিতা? আজীবন
পোড়ার জন্য আগুন তো দিলই। শীতল জলও কি দিল?
ভাবছি তুষার রায়ের কথা। তুষারের ভাই ফাল্গুনী রায়ও কাটিয়ে গেছেন এক জ্বলন্ত জীবন। তবু আজ শুধু তুষার রায়ের
কথাই মনে পড়ছে। ব্যান্ডমাস্টার
তুষার রায়। পরম
প্রতিশ্রুতির মধ্যে জীবন শুরু করে তা শেষ হল যক্ষ্মার অভিশাপে- এক অগ্নিময় যুবকের
অসহায় নিঃসঙ্গ মরণে। এই অভিশাপ শব্দটা কোথাও যেন তাঁর সঙ্গে জড়িয়েই আছে। তাঁর নাম উচ্চারিত হলেই
ভয় করে কোথাও থেকে একদলা কালো রং যেন আমাদের দিকে ছুটে আসছে, আর তার মধ্যে
রক্তের আঁকিবুঁকি। বাংলা কবিতার ভেতো জগতে তিনি উজ্জ্বল নিষিদ্ধ মাংসখণ্ডের
মতো ঝকঝক করতে থাকেন। তাঁর কবিতা শোনার জন্য অফিস-ফেরত ছাপোষা মানুষেরাও
ভিড় করত। তিন
হাজার কবিতা নাকি তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। জমিদার পরিবারের উত্তিরাধিকারের অহংকার ছিল তাঁর রক্তে। অথচ অবিভক্ত মেদিনীপুরের
ডিগরির স্যানাটোরিয়াম থেকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা তুষার রায় তাঁর বন্ধু সুব্রত চক্রবর্তীকে
চিঠিতে লিখেছিলেন,
‘এক ভয়াবহ অ্যাডিক্টেড নেশাকে (অপিয়ম, দৈনিক ব্যবহার ছিল চার টাকার মতো) কাটিয়ে দিলাম স্রেফ
মনের জোরে, এটা যে কতো শক্ত ব্যাপার আশা করি তা বুঝলে,
আমার ক্ষমতায় শ্রদ্ধা মানবেন, দশ বছর ধরে ব্যবহৃত
ওই নেশাকে রক্তের থেকে মুছে ফেলতে মরে যায় মানুষ, কিন্তু আমি
তো মানুষ নই, ঈশ্বরের বিরুদ্ধ ঈশ্বর এক যেন হাঃ…’। এই বিরুদ্ধ ঈশ্বর হয়ে
ওঠাই কি তাঁর জীবনের ব্রত ছিল না? যদি ব্রত শব্দটা আদৌ তুষারের সঙ্গে যায়। যাঁদের স্যানাটোরিয়াম
বলতে থমাস মানের
‘ম্যাজিক মাউন্টেন’ মনে পড়ে যায়, তাঁরা সম্ভবত ডিগরি দ্যাখেননি। আমি দেখেছিলাম। অমন বিমর্ষ পরিবেশ আমি
জীবনে খুব কম দেখেছি। জীবনের প্রত্যেকটা শব্দ হয়ত তুষার রায় মৃত্যুর রঙে লিখতে
চেয়েছিলেন। যদি
মৃত্যুর সত্যিই কোনো রং থাকে। তাঁর মৃতদেহ দেখে বন্ধু ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘আমি সকালবেলা,
ঝুঁকে পড়ে দেখছিলাম, তুষারের দু-চোখের নিচে শুকিয়ে যাওয়া কোনো জলের রেখা আছে কিনা।– না, নেই। ছিলো না।’ বাংলা কবিতা তুষার রায়কে মনে রেখেছে,
কিংবদন্তি করেছে, অবশ্যই, কিন্তু তাঁর কবিতা পড়ার প্রয়োজনীয়তা আজকের এই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি
মাসে কেউ কেউ বোধ করেন কি? আমার কথা বলি? জিপসিদের মতোই কবিতা নিয়ে আমার কিছু সংস্কার আছে। তার একটা হল- তুষার রায়ের
কবিতা পড়লে জীবনে দুঃখ ঘনিয়ে আসে। আমি তুষার রায়ের কবিতা
পড়তে ভয় পাই। যেমন
সাপের ছোবলে মরে যাওয়া নারীর ফেলে যাওয়া গহনা পরতে নতুন বৌরা ভয় পায়।
ভাবছি শম্ভু রক্ষিতের কথা। উপরে যে কবিদের নাম করলাম, তাঁরা সকলেই
একেকজন কিংবদন্তি, কেউ সারা পৃথিবীতে, কেউ
নিজের ভাষায়। শম্ভু রক্ষিত আজও কিংবদন্তি হতে পারেননি। সেটা তাঁর অক্ষমতা নয়, সেটা আমাদের
সমাজের সীমাবদ্ধতা। হয়ত একদিন তিনি কিংবদন্তি হবেন। মানুষ খুঁজবে তাঁর কবিতা। কিন্তু আজও ইন্টারনেট
সার্চ করে দেখুন-
শম্ভু রক্ষিতের কোনো উইকিপিডিয়া নেই। তাঁর এক কাব্যগ্রন্থের
নাম ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’। এই নাম অনেককিছু বলে। হাংরি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। জরুরি অবস্থায় গ্রেফতার
হয়েছিলেন। নিজের
জন্য বা নিজের লেখার জন্য কোনোদিন কোনো নিরাপদ পরিস্থিতি খুঁজে নেননি। এই যে সময়ের মধ্য দিয়ে
আমরা যাচ্ছি, কজন কবি নিজের স্বপ্ন আর নিজের অবস্থানের জন্য জেলে যেতে প্রস্তুত হবেন?
সোশ্যাল মিডিয়ায় যাঁদের বৈপ্লবিক পোস্ট দেখতে পাই, তারপরেই দেখা যায় সরকারি আমন্ত্রণে শাসকের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ছেন। খ্যাতনামারা এখন মেপে
কথা বলেন, যদি শাসকের বদান্যতা বাই চান্স হাতছাড়া হয়ে যায়! তার
মধ্যে দাঁড়িয়ে উস্কোখুস্কো চেহারার দীর্ণ শীর্ণ বেপরোয়া ময়লা পোশাক পরিহিত খ্যা খ্যা
করে হাসতে থাকা শম্ভু রক্ষিতকে আজ গ্রহান্তরের কবি মনে হয়। জীবনে হাত পেতে সরকারের
আনুকূল্য নেননি। সারা
জীবন সম্রাটের মতো বেঁচেছেন, স্বরচিত এক আগুনের প্রাসাদের মধ্যে। ‘মহাপৃথিবী’
নামক কবিতাপত্রিকা তিনি পঞ্চাশ বছর চালিয়েছেন, কোনোরকম সমঝোতা না করে। তাঁর এক কবিতার বইয়ের নাম ‘আমি কেরর না
অসুর’- লেটারপ্রেসে ছাপা অতি দরিদ্র এক কাব্যগ্রন্থ, কিন্তু হাতে নিয়ে কেমন যেন সমীহ জাগে, হতেই পারে আজকের
পাঠক হয়ত নাক তুলবেন- কী বিশ্রী দেখতে একটা বই! দরিদ্র মানুষটি আজীবন অভিজাত কবিতা লিখেছেন, এমন একটা
কবিতাও তাঁর নেই যার মধ্যে জনপ্রিয়তার সস্তা প্রয়াস আছে। হয়ত সেগুলোকে কবিতা বলে
মেনে নেওয়াই অনেক পাঠকের পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ আমাদের সমাজে কবিতা সম্পর্কিত যে
বদ্ধমূল ধারণা প্রতিষ্ঠান জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দিয়েছে, শম্ভুর
কবিতা তার সঙ্গে একেবারেই মেলে না- কারণ সেগুলোর মধ্যে লিপিবদ্ধ
হয়ে আছে তাঁর আগ্নেয় প্রজ্ঞা। শঙ্খ ঘোষ তাঁর গুণগ্রাহী ছিলেন। মলয় রায়চৌধুরী একবার
বলেছিলেন তাঁর মতে শ্রেষ্ঠতম জীবিত বাঙালি কবির নাম শম্ভু রক্ষিত। তাঁর মৃত্যুর পরে সোশ্যাল
মিডিয়ায় যথারীতি চব্বিশ ঘন্টার একটা হৈচৈ হয়েছিল, কিন্তু শেষযাত্রায় সম্ভবত একশ
জন লোকও হয়নি, একজনও তথাকথিত বিখ্যাত কবি তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে
যাননি। এই
যে জ্বলন্ত জীবন-
২০২৪ খ্রিস্টাব্দে কোনো তরুণ যদি কবিতা লিখতে আসেন, তাঁকে সতর্ক করে দেওয়া যেতে পারে- ‘ভাই, ভুলেও শম্ভু রক্ষিতের মতো হতে চেষ্টা করবেন না। শখ করে কবিতা লিখছেন
লিখুন, কিছু মানুষ যেমন ডাকটিকিট জমায়, বাড়ির ছাদে দু-চারটে গোলাপের চাষ করে…’ আমি মনে করি শম্ভু রক্ষিত হলেন
বাংলা কবিতার ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ।
অনুপম
মুখোপাধ্যায়
পরিচালক-
বাক্ অনলাইন